কা তব কান্তা ইত্যাদি

দরকারের সময় কি কাউকে পাওয়ার যো আছে? এইযে বিগত বহুদিন ধরেই আমার শরীরটা ঠিক জুতের নেই, তাতে পৃথিবীর কোন হেলদোল আছে? নেই।
কে না জানে আমি কী পরিমাণ হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, উদয়াস্ত মাথার ঘাম জুতোয় ফেলে (শীতকালে আমি পারলে জুতো পরে শুই) দু- পাঁচ আনা উপার্জন করি, তাতে যদিও হাতি-ঘোড়া কেনা চলে না, তবু খাটনি তো। শুধু তাই না, এরপরেও আবার রান্না করি, ঘর গোছাই, ছেলে মানুষ করি, বাজার দোকান করি, আবদার কতো অ্যাঁ?
তা, দিন গেলো আলে ডালে, তারপর এই হাড় হিম করা বিতিকিচ্ছিরি শীতের শেষে নামল তেড়ে বৃষ্টি। সে কী বৃষ্টি আর হাওয়া রে ভাই। গায়ে তিন পুরু সোয়েটার, জ্যাকেট, মাফলার, ইত্যাদি চাপিয়েও ঠাণ্ডায় হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে রোজ সকালে হাজিরা দেওয়া কি মুখের কথা!! আবহাওয়ার এই আকস্মিক অবিমৃশ্যকারিতায় যা হওয়ার তাই হল। সারাদিন ছোট-বড়-মেজ নানান সাইজের নাসিকা-নির্গত ক্রমাগত মিসিসিপি-মুসুরি এবং হ্যাঁচ্চো। আর ক্লাসময় সমবেত সরু-মোটা-মিহি কণ্ঠ নির্গত খক-খক এর ফলে আকাশে বাতাসে যে অযুত নিযুত সংখ্যক ভাইরাসকুলের সমাবেশ হল তার থেকে বাঁচতে আমার মতন ঘোর বেনিয়মী পাষণ্ড পর্যন্ত কালেভদ্রে হাত-পা ধুচ্ছিল নিয়ম করে। কিন্তু নিয়তি কেন বাধ্যতে।
লুকোচুরি খেলতে খেলতে ওই বেয়াদব ভাইরাসদের মধ্যে একজন আমাকে ধাওয়া করে ঠিক ধরে ফেললেন। মানে ‘আই নেভার ট্রায়েড টু ক্যাচ কোল্ড, ইট কট মি’ আর কি। অতঃপর এক বৃষ্টিস্নাত মঙ্গলবার বিকেলে আমি জ্বরাক্রান্ত হয়ে ঘোরের মধ্যে কোনক্রমে ছেলেকে বগলদাবা করে বাড়ী ফিরলাম ও শয্যা নিলাম। অর্থাৎ, কয়েক ঘণ্টার জন্যে মাত্র। এরপরে দু’দিন গরম গরম সুপ কিম্বা টেংরির জুস খেতে খেতে গল্পের বই পড়ব যে, অত সুখ কপালে নেইকো। ছুটি ফুটি নাই। যে করেই হোক চাঙ্গা হয়ে পরদিন যেতেই হবে। গেলাম। এবার সারাদিনের পর গলা গেলো ভেঙে। ফ্যাঁস-ফ্যাঁস করে অবিকল আমাদের পাড়ার গলায় নীল ঘণ্টি বাঁধা হুলোর মতন আওয়াজ সম্বল করে বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন। এইবারে রান্না করতে গিয়ে আমার চোখ ফেটে জল আসতে চাইলো ও এক ছুটে মার কাছে গিয়ে সকলের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে অন্তত রেডিমেড এক কাপ গরম আদা-চা খেতে ইচ্ছে করতে লাগলো। ইতিমধ্যে ছেলে নানা রকম প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ শুরু করেছে, গলার অবস্থা দেখে মুখ লুকিয়ে দু’বার হেসেছে (কী বলবো আর, রাগ করতেও ভুলে গেছি ততক্ষণে)। ভাইরাস পুঙ্গব যাতে তেনাকেও না ধরে তাই নিজেকে নিজে একঘরে করলাম। আর টিপুকে বল্লাম, যাও তো সোনা, দশ পাতা অঙ্ক করে নিয়ে এসো, আমি চেক করবো। সুযোগ বুঝে সাড়া বাড়ী দখল করে ছেলে তো কার-রেসিং, গারজিয়ান্স অফ দা গ্যালাক্সি, স্টার ওয়ার্স, আরও নানা বিদঘুটে খেলায় তুমুল হুটোপাটি শুরু করে দিলো।
কাঁহাতক সহ্য করা যায় !! আমি ফোন নিয়ে মাকে ডায়াল করলাম। অনেকক্ষণ রিং হয়ে গেলো, কেউ আর ধরেই না। এবার বাবাকে করলাম। যদিও বাবা কানের গোড়ায় ফোন বাজলেও মোটেই শুনতে পায়না। অনেকানেক বার ফোন করতে থাকলে তখন বাধ্য হয়ে ফোন ধরে বলে, আরে তুই ফোন করেছিলি নাকি !! আমি তো শুনতেই পাইনি!! আমার দৃঢ় ধারণা, আমাকে কাটিয়ে দেবার জন্যেই বাবা এইসব বলে থাকে কারণ বেশীরভাগ সময়ে আমি যখন কল করি তখন বাবা হয় দাদাগিরি নয়ত সারেগামাপা নয়তো জি বাংলার অখাদ্য সিরিয়ালগুলো সব গোগ্রাসে গেলে। কী বলবো আর। যথারীতি ফোন কেউ ধরল না। আমার দ্বিগুণ জোরে কান্না পেলো। এবার কী করবো, এই ছাতার দুঃখের পাহাড় ঠেলে বিছানা থেকেই নামতে ইচ্ছে করছে না যে। উপায় না দেখে বোনকে হোয়াটসঅ্যাপে ডাকাডাকি করলাম। সে বিরক্ত হয়ে জানালো বাবা-মা, জেঠু- জেঠিমা এবং আরও অনেকে দল বেঁধে ভুটান বেড়াতে গেছে, রবিবার ফিরবে, আর আমি তো এসব জানি, অযথা ঘ্যানঘ্যান করার কি মানে!!
তক্ষুনি আমার মনে পড়লো, তাই তো, ওদের তো থিম্পু ফুন্তশলিং, আরও কোথায় কোথায় সব যাওয়ার কথা!! এদিকে বোনের ও তার ছেলেরও খুবই শরীর খারাপ, তারাও ভুগছে। তবে কিনা সে আমার থেকে অনেক বেশী রাশভারী মানুষ, অল্পেতে টসকায় না। অর্থাৎ এই দাঁড়ালো যে চারজনেই আমরা (আমি, টিপু, বোন এবং পিংপং) ওষুধের ভরসায় কোনওরকমে টিমটিম করে টিকে আছি আর ইদিকে ওনারা সব ভুটান পাহাড়ে মনের সুখে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছেন!!! আমাদের একেবারে ভুলেই মেরে দিয়েছেন। ফোন অব্দি বন্ধ করেছে, কীরকম হৃদয়হীন ভাবা যায় !!
যাই হোক, বোন আমার অবস্থা দেখে দয়া করে ওদের ভুটানের ফোন নম্বরগুলো দিয়ে বলল খুব দরকার হলে ওতে ফোন করতে। আমি পত্রপাঠ ওই নম্বরে ফোন করতে শুরু করলাম। বারংবার ফোন করে আবার অসফল হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে, গারগল করে, জ্বরের ওষুধ খেয়ে সকলের মুন্ডুপাত করতে করতে আবার আরেক কাশি-অধ্যুষিত নিদ্রাহীন রাত্রিযাপনে উদ্যোগী হলাম।
শুক্রবার আগত, কিছুতেই কিছু হল না দেখে ভোরবেলা কাজে যাওয়ার আগে ডাক্তার দেখাতে গেলাম (আজ্ঞে, একলাই, অত কপাল করে আসিনি। শেষ কবে আমাকে কেউ ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছে মনে পড়েনা)। ডাক্তার অবস্থা দেখে আঁতকে উঠে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিলেন। আমাদের বসন্তোৎসবের জন্যে সেই কবে থেকে কতো উৎসাহ নিয়ে গান-টান প্র্যাকটিস করলাম, সেসব আর হবে বলে মনে হছে না। যাই হোক, শনিবার মেলা চেষ্টাতেও গলা দিয়ে গানের গ ও বের করতে পারলাম না।
এসে গেলো রবিবার, আমি তক্কে তক্কে ছিলাম। ফোন করতে শুরু করলাম আবার। এবারেও কেউ ধরেনা। কী ভেবেছেটা কী এরা !!! এবার একটু একটু চিন্তাও হল। রবিবার গেলো।
যাই হোক, এই সপ্তাহ আমার বসন্তকালীন ছুটি। আজ সকালে সবাই বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই ফোন করলাম। এবারে বাবা ধরল!!! তারপরেই সে কতো গল্প, কীরকম দারুণ বেড়ানো হয়েছে, কেমন চমৎকার খাওয়া দাওয়া, কী অসাধারণ সুন্দর জায়গা, এইসব বিবরণ আর থামতেই চায়না। আমি যে কেমন আছি, আমার গলাটা যে ফ্যাঁসফ্যাঁসে শোনাচ্ছে, সেই নিয়ে কোন ভ্রূক্ষেপই নেই যেন !!! গল্পের তোড়ে হঠাৎ তেনার খেয়াল হল আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ। তখন দয়া করে জিজ্ঞেস করলেন হ্যাঁ, তা তোরা কেমন আছিস বল !! আমি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এই হপ্তার সমস্ত খতিয়ান পেশ করলাম, আর এই ব্যাবহারে যে আমি কিরকম মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছি তাও ঠারেঠোরে জানালাম। কী বলবো, কথার মাঝে যেন একটু খুকখুক হাসি অথবা কাশি শুনলাম, এমনকি একবার কুলকুচির আওয়াজও শুনলাম !! আমার ওপর দিয়ে যে কি সাঙ্ঘাতিক বিপদ যাচ্ছে, তার উত্তর কেবল, ‘এহহে, আবার ঠাণ্ডা লাগিয়েছিস, সকালে মাঙ্কি ক্যাপ পরে গেলেও তো পারিস!! কে হাসল তাতে নজর দেওয়ার দরকার নেই, নিজের সেফটি নিজের হাতে’। এই বলে মাকে ফোন দিয়ে কেটে পড়লো !!!
মা বরং একটু সুর নরম করে কী কী হয়েছে যত্ন করে জানতে চাইল, এমনকি তারপর একটু আহা-উহুও করলো। আমি ব্যাস্ত হয়ে গান বাজনার কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম এমন সময় হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন করে বলল, ওই যাহ গ্যাসে ডাল চাপানো আছে, তুই নিজের খেয়াল রাখিস আর গারগল করতে ভুলিস না কেমন, এখন রাখি তবে? বলে ফোন রেখে দিলো !!!!!!!
এই বুড়োবুড়ি গুলো কী পরিমাণ উচ্ছন্নে গেছে সে চোখে দেখা যায়না সত্যি !!! কী বলবো আর, জীবনে ঘেন্না ধরে গেলো !!! রাগে দুঃখে চারটে কাজু বরফি আর একটা ডালিম খেয়ে ফেলেছি। এখন আবার অতটা খারাপও লাগছে না। দেখি কালকে ফোন করে ভুটানের ফটোগুলো পাঠাতে বলবো :/

Leave a comment