নান ইজ ফান

গত সোমবার কাজ শেষ করে সাড়ে আটটা নাগাদ রান্নাঘরে গিয়ে দেখি চাপা উত্তেজনা, ফিসফাস, কীসব রান্না চলছে ! আমাকে দেখে ছোট মিত্তির রহস্য করে বললেন , আজ আমাদের ডিনার করতে একটু দেরী হবে, তাই না বাবা? উত্তরে তেনার বাবা বললেন হ্যাঁ, এই ধরো সাড়ে ন’টা । উঁকি দিয়ে দেখি পালক পনীর বানানো হয়েছে আর মেঝেতে কাউন্টারে যত্রতত্র ময়দার গুঁডো় । দইয়ের কৌটোর ঢাকনা গড়াগড়ি টেবিলে। আমি পেটরোগা মানুষ, শাকপাতা খাইনে। তাই পালক পনীর নিয়ে একটু খিটখিট করলাম। চাল ভেজানো নেই, ময়দা মাখাটাও কোথাও দেখলাম না। কী ছাতার মাথা হচ্ছে কিছু না বুঝে স্নান করতে গেলাম। এসে দেখি ভেজা কাপড়ে ঢাকা গোপন টেকনিকে মাখা ময়দার তাল বেরিয়েছে। নান বানানো হচ্ছে !! যাই হোক, সে মহা কর্মযজ্ঞ। সোজা ব্যাপার না। ময়দার লেচিকে কাউন্টারে তেল মেরে তার ওপর ফেলে এক দুই টানে লম্বাটে করে বেলতে হচ্ছে তারপর রসুন কুচি, জোয়ান, ধনেপাতা এসব ওপরে চেপে চেপে দিতে হচ্ছে। এরপরেই আসল চমক। চাটুকে হাল্কা গরম করে সেই বেলা ময়দার উলটো দিকে জাদুর গালে হাত বোলানোর মত করে একটু জল বুলিয়ে নিতে হচ্ছে। এরপর সেই জলের দিকটা থ্যাপ করে ঘুঁটে দেওয়ার মত করে চাটুতে ফেলে একটু সেঁকেই আঁচ বাড়িয়ে নান শুদ্ধু চাটুকে জ্বলন্ত নগদ আগুনের ওপর উলটো করে ধরতে হচ্ছে। এইসময়ে বেশীরভাগ ধনেপাতা ও জোয়ান মাধ্যাকর্ষণের শক্তির কাছে হার মেনে কুকটপে টপাটপ করে পড়ে যাচ্ছে আর রান্নাঘর ভরে উঠছে গারলিক নানের লোভনীয় গন্ধে। নান সেঁকা হয়ে যেতেই তাঁদের গায়ে মাখানো হচ্ছে পাঁচশো গ্রাম করে মাখন। তারপর নান আর পালক পনীরের মোচ্ছব তো শেষ হল রাত প্রায় সাড়ে দশটায়। চারদিকে চেয়ে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করতে গিয়ে মনে হল এইমাত্র এখানে একটা বিশ্বযুদ্ধু হয়েছে। কালকেই যে ঘনঘোর পরিশ্রম করে পরিষ্কার করা হয়েছিলো বোঝাই যাচ্ছে না। সে যাক গে, গরম গরম গারলিক বাটার নান যা হয়েছিলো না, যেকোনো দোকানকে বলে বলে দশ গোল দেবে। সাহস করে পালক পনীর খেতে পারলাম না, তাই আগেরদিনের চিকেন কষা দিয়েই খেলাম দুটো। লাইফ পুরো ঝিঙ্গালালা 😀

যার শিল, যার নোড়া..

আমি মিক্সড ব্রিড হলেও মিত্তির মশাই হচ্ছেন পিওর ঘটি। তার ভাষায় শহুরে ভেজাল থাকলেও শ্বশুরবাড়ী একেবারে ‘এইচি’ ‘খেয়েচো’ ‘বলেনি কো’ লেভেলের সিরিয়াস ঘটি। তদুপরি আবার বর্ধমানের আদি বাসিন্দা। ওয়াঁরা সকালে উঠে পারলে পোস্তর সরবত দিয়ে কুলকুচি করেন। পেটখারাপে কাঁচা পোস্ত বাটা, মন খারাপে পোস্ত বড়া, ফূর্তি হলে আলু পোস্ত, সব ঠিকঠাক থাকলে ঝিঙে/বরবটি/ঢ্যাঁড়স যা খুশী পোস্ত, এরকম ব্যাবস্থা আর কি। তা, আমাদের সংসারে কয়েকদিন পরপরই পোস্ত বাটা লাগে। এদিকে পাঁড় ঘটি মিত্তিরমশাইয়ের আবার স্পাইস গ্রাইন্ডারে মন ওঠে না। অত্যধিক রকম পোস্ত বেটে বেটে আমার কত যে নামী ব্র্যান্ডের দামী গ্রাইন্ডার অকালে দেহ রেখেছে তা বলার নয়। কয়েক দানা গোটা থাকলেও সেই গ্রাইন্ডার ফেল। অতএব কয়েক বছর আগে একদা ছেলে স্কুলে থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা দুইজনা মধ্যাহ্নভোজনে গিছিলাম। তারপর এদিক সেদিক কিঞ্চিৎ কেনাকাটা সেরে বাঙালীর তীর্থক্ষেত্রে গিয়ে হাজির হলাম, অর্থাৎ মাছের বাজারে। সেখানে গিয়ে কি যেন দেখে মিত্রবাবুর চোখে মুখে অনির্বচনীয় পুলকের ঝলকানি ও চোখে আনন্দাশ্রু দেখে ভেবলে গিয়ে সামনে দেখি মেঝের ওপর সারি সারি দাঁড় করানো বস্তায় বাঁধা দশ বারোটা কি যেন !! এসব কী রে বাবা? আমি বুঝতে না পারলেও ঘটিনন্দনের এক্সরে চোখে ধরা পড়ে গেছে ভিতরের যন্ত্রপাতি। কিছুই না, আদি অকৃত্রিম শিল ও নোড়া !! শিল নোড়ার পুরোপুরি ব্যাবহার শেষ দেখেছি আমার দিদার বাড়ীতে। সেখানে রোজ সকাল বেলা হতেই উনুনে আঁচ পড়তো, গলগলিয়ে ধোঁওয়া ওঠা উনুন খানিকক্ষণের জন্যে বাইরে রেখে এসে ঘড়র ঘড়র করে মশলা বাটতে লেগে যেত বিন্দুমাসি। কতকগুলো থোরের খোলার শুকনো টুকরো দিয়ে কাঁচিয়ে কাঁচিয়ে তার মশলা বাটা কতদিন পাশে বসে দাঁত মাজতে মাজতে দেখেছি। লাল-হলুদ-সবুজ বাটনা একেকটার এক এক রকম রঙ ও গন্ধ। সে এক ম্যাজিকাল ব্যাপার। আমার আগ্রহ দেখে এক-দুবার আমাকেও শিল বাটতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। মায়ের রান্নাঘরে হাইব্রিড ব্যাবস্থা, শিল নোড়া থাকলেও মিক্সিতে কাজ হয় বেশী। ক্বচিৎ কখনও বিশেষ মেন্যুর প্রয়োজনে শিল নোড়া ব্যাবহার হত। আর আমরা তো এখন গুঁড়ো মশলা দিয়েই কাজ চালাই। এই অবস্থায় বস্তাবন্দী শিল নোড়া দেখে মাছ-টাছ ফেলে উনি তার জন্যে পাগলপারা হলেন। আমি যত বোঝাই ওরে আমার তো বারোমাস হাতে ব্যাথা, মাজায় ব্যাথা, বুক ধড়ফড়, পেট গড়বড়, কোমরে বাত, নড়বড়ে দাঁত এতে পোস্ত বাটবে কে, এই ভারী জিনিস তুলবেই বা কে? তিনি অভয় দিয়ে বললেন, কুছ পরোয়া নেই, আমি হাই স্কুলে পড়তে অনেকবার শিলনোড়ায় পোস্ত বেটেছি, তুলে ধুয়ে রেখেছি, আমিই সব করবখন। এদিকে, আমি নিজে তো হাই স্কুলে থাকতে হাই ছাড়া কিছু তুলিনি তাস ছাড়া কিছু বাটিনি। সে যাক, বলছে যখন নিয়েই দেখা যাক। তা কেনা তো হল, তারপর তার যত্ন দেখে কে!! বাকী সব মাথায় উঠল, কোথায় সেই সুন্দর স্বর্নালী সন্ধ্যায় দুজনে-কুজনে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে বলতে বাড়ী ফিরব তা না, আমার কোলে চাপল সেই দশমণি নোড়া ও পায়ের কাছে কুড়িমণি শিল। কী? না, রাস্তায় এদিক ওদিক গড়িয়ে ধাক্কাধুক্কি লেগে যদি ওনাদের কিছু হয়। সেই থেকে ইনি আমাদের বাড়ীতে আছেন। না, আমার স্পাইস গ্রাইন্ডারকে পদচ্যুত করতে পারেননি। অবরে সবরে ইনি বের হন ও সেদিন আমরা চন্দনের মতন বাটা পোস্ত পাতে পাই 🙂 তবে পোস্ত ছাড়াও এতে দারুণ হয় নামমাত্র জলে ডাল বাটা, সেই দিয়ে মহা চমৎকার ডালের বড়া হয়। রোজ রোজ এসব হয়না অবশ্য, যখন হয় তখন তাই ছবি তুলে রাখতে হয়। আর ইয়ে, আমার এখনও হাত ব্যাথা, মাজায় বাত, কান কটকট তাই শিলনোড়া বেরোলেই বাটনা বাটেন মিত্তিরমশাই, আর বাকী রান্নাটা করি আমি 😀

শৈশব, সানন্দা ও ভেটকি বেগম্বাহার

কাজের চাপে চিড়েচ্যাপটা তার ওপর পৃথিবীতে বিবিধ ক্যাচাল সামলাতে নাভিশ্বাস হয়ে কদিন প্রায় নাওয়া-খাওয়া বন্ধ রাখতে হয়েছিলো। কিছু রান্না আগে করেছিলাম কিন্তু আর পোস্ট করা হয়ে ওঠেনি। আগে গল্পটা বলে নিই। আমার মা নিজের ছোটবেলায় ছিল পাড়া-কাঁপানো মাস্তান। এদিকে ডাকসাইটে সুন্দরীও বটে। মামাবাড়ির পাড়ায় গেলে এখনও বয়স্করা বলে ‘ও তোরা বেবির মেয়ে? বেবি যা ডানপিটে ছিল, হাড় জ্বালিয়ে খেয়েছে’ ইত্যাদি। সমাপ্তির মৃন্ময়ীর মতনই মায়ের টমবয় থেকে গৃহিণী হয়ে ওঠার গল্প। এই ডানপিটেপনার পিলে চমকানো সব গল্প শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। তাই সানন্দা নামক টিপিকাল সুগৃহিণী, ঘর-গোছানি, সাজুনেবালাদাসী ও লক্ষ্মীমেয়েদের লক্ষ করে যে ম্যাগাজিন বেরোল, মা যখন তার প্রথম সংখ্যা থেকেই হঠাৎ একনিষ্ঠ পাঠিকা হয়ে গেলো তখন আমরা যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম। তখন সানন্দা এতো চকচকে পালিশ কাগজে বেরত না। বাংলা ছবির জনপ্রিয় পরিচালিকা, সুন্দরী অভিনেত্রী ছিলেন তার সম্পাদক আর ছিল বিবি রাসেল, সুদেষ্ণা রায়, সুতপা তালুকদার, রুকমা দাক্ষী ইত্যাদি কর্মঠ সব কাজের মানুষদের নিয়মিত অবদান। আমাদের বাড়ীতে মাসে দুটো করে সানন্দা আসা শুরু হল, আজ অব্দি বন্ধ হয়নি। এবার, সানন্দা পড়ে মা কতোটা লক্ষ্মীমেয়ে হতে পেরেছিল সে জানিনা তবে আমি খুবই দুষ্টুমেয়ে হয়ে উঠলাম অচিরেই। মেয়েলী নানা ‘নিষিদ্ধ’ বিষয়ে জ্ঞানার্জন, বড়দের জন্যে লেখা গল্প পড়া, হালফ্যাশনের সাজগোজ তো ছিলই, এমনকি কদিন পরে শুরু হল তারকাদের ধারাবাহিক জীবনী। ‘আমার জীবন আমার উত্তম’ এর টানটান উত্তেজনা, বাঙালীর হার্টথ্রবের হার্টে কে ফাইনালি পাকাপাকি বসত করবে, অবিবাহিতা সাহসী অভিনেত্রী নাকি আটপৌরে বিবাহিতা বউ? সে কি ভোলা যায়। কিম্বা ‘আমার মা সব জানে’র প্রশ্নগুলো – খুবই ইন্টারেস্টিং কারণ ওরকম প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকলে অন্যের মা কি করতো জানিনা, তবে আমার মা ‘যাজ্যাহঃ ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ করিস না, আমার কাজ আছে’ বলে ভাগিয়ে দিতো সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। সবথেকে বেশী যেটা ইন্টারেস্টিং ছিল তা হল ‘কানেকানে’ নামে এক বিভাগ !! উরে:, সে পুরো হ্যালু ব্যাপার। কার মাস্টারমশাইয়ের ওপর ক্রাশ কিন্তু তার সন্দেহ যে তার মায়েরও ওই একই মাস্টারমশাইয়ের ওপর ক্রাশ, এবার সে কি করবে বলে দাও (বয়েসের অগ্রাধিকার হিসেবে মাস্টারমশাইকে মায়ের জন্যেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ) !! কার আবার স্বামী ঘনঘন ট্যুরে যায়, পরিবারের সন্দেহ যে স্বামী পুরনো প্রেমিকার সঙ্গে ফুর্তি করতে যায়, প্রমাণ – স্বামীর ছাড়া-ছাড়া ভাব, পুত্রের পিটিএমে না যেতে চাওয়া, এবার তাকে বলে দিতে হবে সে কীভাবে স্বামীকে পথে আনবে!! (পিটিএমে কেই বা যেতে চায় মশাই), কিম্বা বরকে ননদ আর শাশুরি মিলে তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত লেলিয়ে দেয়, এর প্রতিকার কি !! (দুবেলা নিয়ম করে জলবিছুটি, আবার কি)…এইধরনের জ্বলন্ত সামাজিক সব সমস্যা। এগুলো তবু এখানে লেখার মতন বিষয়। এছাড়াও এমন এমন অনেক চিঠি আসতো যার সাক্ষর অতি অবশ্যই ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ এবং তাতে লেখা থাকতো গা ছমছমে সব ‘পরিণত বয়স্ক’ সমস্যা। এইসব যাকে বলে bizzare সমস্যাগুলোর উত্তর ধৈর্য ধরে যিনি লিখতেন তাঁর চরণে শতকোটি পেন্নাম। সে যাই হোক, এই কানেকানে পড়ার জন্যেই সানন্দা ঘাঁটাঘাঁটি করতাম আমি। বছরখানিক পর এক গরমের ছুটিতে আমার পিসির বাড়ী বেড়াতে গেলাম। গরমের ছুটিতে পিসির বাগানবাড়ীতে প্রায়ই গিয়ে কয়েক সপ্তাহ থেকে খুব আনন্দ করতাম আমরা দুইবোন। সেখানে আমার তিন দাদা ও আরেক পিঠোপিঠি ভাই। সেই ভাই আর আমি সারাদিন আগানে-বাগানে ঘুরে নানা কুকীর্তি করে বেড়াতাম। এইরকমই এক দুপুরে বড়দাদার চিলেকোঠার ঘর ফাঁকা দেখে সেখানে জিনিসপত্র ঘেঁটে গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে দাদার গার্লফ্রেন্ডের কথা আবিষ্কার করে ফেলি ও তাকে যারপরনাই বেকায়দায় ফেলি। সে যাক, আসল ঘটনা হল, এরকম একদিন দাদারা কেউ আশেপাশে নেই, টিউশানে বা ফুটবল খেলতে গেছে। ময়দান ফাঁকা। তখন দোদোন আর আমি আবারও জিনিসপত্রে পুলিশি তল্লাশি করতে গিয়ে দাদাদের ঘরে খাটের তলা থেকে এক প্যাকিং বাক্স ভর্তি বই আবিষ্কার করে ফেললাম। সে সাঙ্ঘাতিক জিনিশ, পুরো রোমহর্ষক সব ইংরিজি বই !! সেরকম আমরা তার আগে কোনোদিন দেখিনি !! সানন্দার কানেকানে কে তার পাশে চুষিকাঠি মুখে নির্বোধ শিশু মনে হবে, এইরকম লেভেল !! ব্যাস। আমরা এক ধাক্কায় সানন্দা থেকে প্লেবয়তে উত্তীর্ণ হলাম। এমন অবস্থা হলো, বাড়ীতে সানন্দা এলেও ‘এ আর এমনকি, ছোঃ’ এরকম ভাব করে হেলাফেলায় কয়েক পাতা উল্টে দেখতাম কি দেখতাম না। সব কৌতূহল মিটে আবার নিজের গল্পের বইগুলোর দিকেই মনোযোগ দিলাম, বড়দের ব্যাপারে একটা করুনামিশ্রিত অবজ্ঞা দেখা দিলো (ছ্যা ছ্যা, এর জন্যে এত?)। যা বলার জন্যে এতো কথা বল্লাম তা হল, সানন্দা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে, মেলা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু রেসিপিগুলো এখনও চ্যাম্পিয়ন। কালেভদ্রে দুএকটা ভালো লেখাও পাওয়া যায় !! তাই পূজাবার্ষিকী সানন্দা পেলে কিনে ফেলি। এ-বছর সানন্দায় দেখি ‘ভেটকি বেগমবাহার’ বলে মাছের এক পদের রেসিপি দেওয়া। ভেটকি তো পাওয়া যায়না, ভেটকির ফসিল পাওয়া যায় এখানে, সেসব খেতে একদম ইচ্ছে করেনা। তো আমি বানিয়েছিলাম ক্যাটফিশ ফিলে দিয়ে। বেশ হয়েছিলো। রেসিপির ছবি আর বেগম্বাহারের ছবি দিলাম। কেবল ছোটোমিত্তির রেসিপির নাম কানে শুনে জানিয়েছিলেন ‘কি, বেগুন আমি খাইনা। বেগুন বাহার বানাবে না, পনীর বানাও তাহলে’ !! তাকে ‘অলম্বুষ, জাম্বুবান, কুরুবক’ ইত্যাদি বলে রান্নাটা নামালাম যখন তখন দেখা গেলো সেই সবথেকে বেশী চেটেপুটে খেয়েছে !!!

দাবানল 2020

ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান হোসে সহ সমগ্র বে এরিয়া অর্থাৎ প্রশান্ত উপকূলবর্তী বেশীরভাগ অঞ্চল গত এক সপ্তাহ ধরে প্রবল দাবদাহে জ্বলছে, আক্ষরিক অর্থেই জ্বলছে একদম। গত বুধবার থেকে তাপমাত্রা একশো ডিগ্রি ফ্যারেনহাইটের আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছে এই গতকাল অব্দি। উপত্যকার ভেতরের শহরগুলো যেমন লিভারমোর, ড্যানভিল, এসব জায়গায় আরও বেশী। গত সপ্তাহে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালিতে উঠেছে – ১৩০ ডিগ্রি ফ্যারেনহাইট, অর্থাৎ ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকেও একটু বেশী !!! এরই মধ্যে মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতন রোববার ভোর রাতে বিকট বজ্রবিদ্যুতসহ ঝড় হয়েছে এসব জায়গায়, বৃষ্টি নামমাত্র। গ্রীষ্মের শেষদিকে এদিকের সব পাহাড়ের রঙ হয়ে যায় সোনালি হলুদ, কারণ আপেক্ষিক আর্দ্রতার নিতান্ত অভাবে ঢালাও তৃণভূমি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। আবার, এদিকের গাছপালা সব চিরহরিৎ পাইনগোত্রের (জিমনোস্পার্ম), যাদের সারা শরীরে ভর্তি দাহ্য তেল। গরমের দু-তিন মাস ধরে এরা শুকোতে শুকোতে ঝামা হয়ে যায় আর গোটা পাহাড়তলি একেবারে জতুগৃহ হয়ে থাকে। এতে সামান্য স্ফুলিঙ্গ পড়লেও, এমনকি শুষ্ক ডালে ডালে ঘষা লাগলে দাবানল লেগে মাইলকে মাইল নিমেষের মধ্যে জ্বলে যায়। অথচ, এই জঙ্গলগুলোতে এটা খুব প্রাকৃতিক ব্যাপার, প্রতি বছর বাজ পড়ে মাঝারি আগুন লেগে পুরনো গাছ মরে এইসব পাহাড়ে নতুন গাছপালা গজাবে এটাই নিয়ম। কিন্তু বেশ কয়েক বছর যাবত ‘ফায়ার সাপ্রেসিং’ এর নাম করে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলে বিক্রি করা হয়েছে, এবং তারপর পাহাড়ে বহু নতুন বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে, প্রাকৃতিক উপায়ে তৃণভূমির ‘বিরলীকরন’ (থিনিংকে বাংলায় কি বলবো?) প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এই থিনিং না হলে পাহাড়ে জ্বালানি জমতেই থাকে, পরিণামে এইরকম বিশাল আকারের আগুন স্বল্পসময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এবার, ‘সাপ্রেসিং’ এর নামে পাহাড় ন্যাড়া করে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট তৈরি হয়ে সেসব আগুনের গতিপথের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে ঢুকে পড়েছে। আর, যথেচ্ছ গাছপালা কেটে ফেলার জন্যে আবহাওয়ার ক্ষতি হয়েছে, পরিবর্তন তো হয়েইছে। কোন কোন মতে দুশ বছরের ওপর এখানে দরকারি আগুন লেগে পরিবেশের প্রাকৃতিক নবীনকরণ হয়নি যেটা হওয়া দরকার ছিল। এইসব খোদার ওপর খোদকারি করার ফলাফল হিসেবে এখনকার আগুনগুলো মস্ত মস্ত, নিয়মকানুনহীন এবং জনবসতির অতি কাছাকাছি। কয়েকদিন ধরে রোজ চেনাশোনা মানুষদের ইভাকুএশানের আতঙ্কের আঁচ পাচ্ছি। লোডশেডিং চলছে ১৭…২০…২৭…৫০ ঘণ্টা অব্দি !! ইন্টেরনেট তো অসম্ভব আন্সটেবল। বাইরে ১১০ ডিগ্রি গরমে মানুষ লোডশেডিঙে বাচ্চাদের ঠাণ্ডা রাখতে বরফজলে হাত, পা ডুবিয়ে বসিয়ে রাখছে। কাল সারাদিন দরজা জানলা বন্ধ রাখা সত্ত্বেও ঘরে ধোঁওয়া ঢুকেছে কোনও ফাঁক ফোকর দিয়ে। বাইরে তাকালে আকাশ, সূর্য, আলো সব অস্বাভাবিক কমলা রঙের দেখাচ্ছিল, এরকম কোনোদিন দেখিনি। কুয়াশার মতন পাতলা ছেয়ে রঙের ধোঁওয়া ভাসছে বাতাসের ওপর। আজ সকালে অনেকটা তাপমাত্রা কমেছে দেখছি, কমলা রঙটাও অতটা নেই, অর্থাৎ এদিকের ছোট একটা আগুন ছিল সেটা বশে আনা গেছে। কিন্তু এখনও বহু মানুষ বিপদে, সমানে ইভাকুএশান চলছে। আর হাওয়া শুরু হল যথারীতি, যার জন্যে আগুন নেভানোর কাজ আরও অনেক কঠিন হয়ে গেলো। এর মধ্যেই খাওয়া দাওয়া করতে হয়, স্কুল কলেজ, অফিস সব করতে হয়। ছোটদের গল্প বলে ভয় কাটিয়ে দিতে হয় – ছেলেকে বল্লাম রাতে লোডশেডিং মান্যেই তো দারুণ মজা, ভূতের গল্প আর ভাইবোনেরা মিলে মুড়ি সিঙ্গারা খাওয়া। মাছ ভাজা, সয়াবিন দিয়ে ডাল আর ভাত ছিল রাতের মেন্যু। সবাই সাবধানে থেকো… সতর্ক থেকো, খুব খারাপ সময় চলছে। 🙁

সরস্বতী পুজো

একটা পুরনো লেখা, যারা পড়েছেন আগে, তারা আমার বাজে বকা সম্পর্কে নিশ্চই ওয়াকিবহাল, সুতরাং আর মোটে পাত্তা দেবেন না যেন 😛আমাদের স্কুলে সরস্বতী পুজো হত না। তাই বাল্যপ্রেম ভ্যালিডেট করতে আমাদের ক্ষেত্রে হরমোন ছাড়া অজুহাত নেই। তবে কিনা ছুটি থাকতো আর থাকতো দিদার বাড়ীতে বড় প্রতিমার বিরাট পুজো। সুন্দর পরিপাটি শাড়ী সামলিয়ে ললিতলবঙ্গলতা সম সমগ্র এলাকার বালকদের বুকে আয়লা তুলে ধীরপায়ে হেঁটে যাচ্ছি এই দৃশ্য দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করা সম্ভব না। বরং, ‘ওঠ রে, ওঠ রে ’ করে বেশ দেরীই হয়ে যেত। স্নান সেরে (হলুদটা একটু বড় হওয়ার পর রিফিউজ করতাম, কেমন জন্ডিস হয়েছে মনে হয়) বেলা বারোটা নাগাদ হুটোপাটি করে মা একটা শাড়ী পরিয়ে দিতো। অতঃপর দেখা যেত বোনকে বগলদাবা করে আমি উর্দ্ধশ্বাসে রেল লাইন পেরিয়ে দিদার বাড়ির দিকে ধাবমান। অঞ্জলি নয়, খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে যাবে কিনা তাই ! সুতরাং, পুজো টুজো যাই হোক, সব পথো এসে মিলে গ্যাচে শেষে এই সুবিশাল ভুঁড়িতে আর কি। ‘কিরে, এইমাত্র অঞ্জলি হয়ে গেলো যে’।একটু হেঁ হেঁ করে তারপরেই ফল প্রসাদ, আমার খুব প্রিয় চাল প্রসাদ আর টুকটাক মিষ্টি। এরপর দিদা যা একখানা মারকাটারি ভোগের খিচুড়ি বানায় না, না খেলে বিশ্বাস করবে না কেউ। সেই খিচুড়ি এক খাবলা ঘি দিয়ে। সঙ্গে লাবড়া, বেগুনী, আরও নানান ভাজাভুজি, নতুন আলুর দম, চাটনী আর দই মিষ্টি তো আনলিমিটেড। খেয়ে-দেয়ে দিদার সাথে একটু গল্প করে আবার ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন অর্থাৎ বাড়ী। রাস্তা দিয়ে দেখতাম হলদে শাড়ী টারী পরে গ্যাঁটম্যাট করে গুচ্ছ গুচ্ছ আমাদেরই বয়েসী মেয়েরা যাচ্ছে। সাথে আবার সাইকেলে কেত মারতে মারতে অকালপক্ক চ্যাংড়া ছোঁড়ার দল। সুন্দরীদের অনেকের হাইট যেমন চার ফুটের সামান্য এদিক ওদিক, ছেলেপুলেরাও তেমন রিকেট-রুগী প্যাংলা সেপাই, গোঁফ গজায়নি। খুবই রোমহর্ষক ব্যাপার স্যাপার। অতএব কথা হলো এই যে, পুজো মানেই আমার কাছে বেশী প্রাধান্য পায় আনুষঙ্গিক পেটপুজোর ব্যবস্থাটা। তা সেই ঐতিহ্য মেনে কালকে বানানো হয়েছিলো হিঙের কচুরি ও আলুর তরকারি। কেবল ছেলেকে ঠাকুরের সামনে বই দিতে বলায় সে জিজ্ঞেস করেছে ঠাকুর কি বইয়ের মধ্যে এনচ্যান্ট করে দেবে? বলেছি হ্যাঁ দেবেখন। তারপর শুনলাম নিম্ন কথোপকথন -বাবা- বাব্বাঃ , কচুরিগুলো তো বেশ ভালোই হয়েছে, তোর মা আমাদের বাড়ির সরস্বতী কি বলিস? লক্ষী বলাটা আবার বাড়াবাড়ি হবে ! ছেলে- হ্যাঁ সরস্বতী, তবে টোয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট। লক্ষী টোয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট আর বাকীটা…বাবা- বাকীটা কী রে? ছেলে (গলা নামিয়ে)- কালী !!! এরপরেও এদের কচুরি বানিয়ে খাওয়ানো উচিৎ কি?তা এবছরও খ্যাঁটন মন্দ হয়নি – লুচি-বেগুন ভাজা, বাঁধাকপির ঘন্ট, পোলাও, পনীর পকোরা তথা টিক্কা। এমনকি রসগোল্লা !! এরপর তুলসি চক্কোতি স্টাইলে আমার বলতে ইচ্ছে করছে – “সংসার হবে বটবৃক্ষ, মানুষ তেতেপুড়ে এসে দু দন্ড জিরোবে। এ যেন খেজুরগাছ। কাঁটা আছে, ছায়া নেই”

আলু ভাজা

ঝিরি ঝিরি আলুভাজা পাই যদি এক ঝুড়ি সোনামুগ ডাল দিয়ে নিমেষে খতম করি ।।আমাদের ছোটবেলায় কাজের বাড়ীতে দুপুরবেলায় পাড়াশুদ্ধু সকলের নেমন্তন্ন থাকতো। এমনকি তেমন-তেমন নিকটাত্মীয় হলে সাতদিন অরন্ধনের ব্যাবস্থাও ছিল। সেসব দিনে দিব্যি সোনা মেয়ের মতন সক্কাল সক্কাল ছান টান সেরে পরিষ্কার জামা পরে হাজির হতাম। কারণ দেরী হলেই ওবাড়ী থেকে বারবার ডাকতে আসবে। তারপর মা-মাসিদের আড্ডা বসবে মস্ত হলঘরে গোলাকৃতি হয়ে বসে। মাথার চুল রোদ্দুরে পাকাইনি হে, রীতিমতো নিয়ম করে বড়দের আড্ডায় আড়ি পেতেছি, আরও অনেক কিছুই করেছি, সেসব কথা এখন থাক। খানিক পরেই খাবার ঘরে। নড়বড়ে কাঠের চেয়ারে বসে কাঠের ততোধিক নড়বড়ে টেবিলে জলের ছিটে মেরে একজন মস্ত রোল থেকে হুড়ুৎ করে সাদা কাগজ পেতে দিয়ে যাবে। আজকাল অন্য কায়দা হয়েছে অনেক। ঝকঝকে করে ধোওয়া কলাপাতায় এক পাশে নুন আর এক টুকরো লেবু দেবে। শুনেছি ছোট পিসির বিয়ের সময়ে স্টেশান মাষ্টার দাদুর আরেক স্টেশান মাষ্টার বন্ধু পুরো এক কামরা ভর্তি কলাপাতা পাঠিয়েছিলেন। এরপর ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত (বাসমতী নয় কিন্তু) আর এক ডাবু হাতা সুগন্ধী সোনামুগের ডাল। তারপরেই আসবে সে – এক খাবলা ঝিরিঝিরি আলু ভাজা। আমি এই দুটো জিনিশ দিয়েই এখনও পুরো ভাত খেয়ে নিতে পারি। কাজের বাড়ীর রান্নার জায়গায় অর্থাৎ ছাদে কি মাঠে ঘুরঘুর করে দেখেছি ওনারা হাতে করে শুধু বঁটিতে কেমন ম্যাজিকের মতন সরু সরু আলু কাটেন। কোথায় লাগে চাইনিজ নাইফ স্কিল!! আমি অবশ্য এগুলো স্লাইসারে আড়াআড়ি তারপর হাতে করে লম্বালম্বি কেটেছি, একটু চিনে বাদাম ভাজা আর ওপর থেকে কারিপাতা ভাজা। ব্যাস। অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ – আমার তিনবছর বয়েসে দীপ্তিমাসির বিয়েতে এরকম এক দুপুরভোজে আলুভাজার কুহকিনী মায়ায় সম্মোহিত হয়ে আমি “আমাকে দালের খিচুড়ি আর আলুভাজা আরও দাও, আরও দাও” করে প্রচুর খেয়ে ফেলে শেষে ছিপি আটকাতে না পেরে ওই টেবিলেই তৎক্ষণাৎ সমস্ত ‘ডালের খিচুড়ি’ অবিকৃত রূপে কুট্টির সিল্কের শাড়ি ভিজিয়ে পরিত্যাগ করি !! আমার এই অবিমৃশ্যকারিতায় যারপরনাই অপ্রস্তুত হয়ে কুট্টি পরিষ্কার করে দিতে চাওয়ায় আমাকে অত্যধিক লাই দেওয়া দীপ্তিমাসি নতুন কোরা শাড়ি পড়া অবস্থায় এসে নিজে হাতে সেসব পরিষ্কার করে আর আমার জন্যে আরও খানিক আলুভাজা টিফিন কৌটো করে দিয়ে দেয় !! এইসব গৌরবময় অতীত কবেই পিছনে ফেলে এসেছি। তবে এখনও সময় থাকলে ঝিরিঝিরি আলুভাজা বানাই আর স্মৃতির সরণী বেয়ে ঝিকিমিকিরা মনটাকে ভালো করে দিয়ে যায় –

বড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি

তা হয়েছে কি, হপ্তা কয়েক হলো কাজের অমানুষিক চাপ চলছে। রাতে ঘুম অব্দি হয়নি দুদিন। এদিকে, কবে যেন আলাদীন থেকে আনা যাবতীয় বড়ি ফুরিয়ে গেছে। অস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে হেঁসেলের দায়িত্ব যার হাতে, তিনি বেশ কয়েকবার কথাটা কর্তৃপক্ষকে (অর্থাৎ আমাকে) জানিয়েছেন। কিন্তু আমার মগজে ঠিক রেজিস্টার করেনি ব্যাপারটা। ওমা, একদিন দেখি ঘরর্ঘরর্, ঠুকঠাক, খটাং মহাশব্দ…রান্নাঘরে হুলুস্থুল ও খোকার ব্যস্তপায়ে আনাগোনা !! গিয়ে দেখি মহা কর্মযজ্ঞ চলছে। ডাল ভেজানো ছিল, সেসব বাটা হচ্ছে !! এমন গা-পিত্তি জ্বলে গেলো, একটু তর সয়না এদের !! চুপচাপ চলে এলাম, মনে মনে ভাবলাম কেমন পারো দেখি, একটু পরেই তো আমাকে ডাকতে হবে বাছাধনের। বসে আছি, বসে আছি।। খানিক পড়ে আবার মহাশব্দ। এবারে ‘ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ ‘ করে বিকট আওয়াজ। আবার ছুটে গিয়ে দেখি ডাল বাটা হয়ে গেছে, ফেটানো চলছে !!! কেক ব্যাটার বানানোর বিটার দিয়ে মিক্সিং বোলে বড়ির ডালবাটা ফেটাচ্ছেন হায়দার আলি এবং টিপু সুলতান লেগো-টিনটিন ফেলে জুলজুল করে চেয়ে আছে, মুখে চোখে বিজাতীয় উত্তেজনা !! এবার একটু খারাপ লাগলো, বল্লাম আমি কিছু করবো? হায়দার আলি বললে, নান্নাহ, তুই কাজ করগে !!! এইসা রাগ হল না !! আবার খোঁটা দেওয়া হচ্ছে !! গজগজ করতে করতে চলে এলাম, রোসো বাছারা, দেখি কেমন পারো, একটু পরে তো সেই আমাকেই ডাকতে হবে। খানিক বাদে সব আওয়াজ শান্ত, চারদিক নিস্তব্ধ। তারপর ঠুং ঠাং ও কাগজের খড়মড়ানি। দৌড়ে গিয়ে দেখি বেকিং ট্রে বেরিয়েছে তার ওপর পার্চমেন্ট পাতা হচ্ছে। এবার বড়ি বসবে !!! এবারে ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, একটু পরে তো সেই আমাকেই ডাকবে !! দেখি দিব্যি টুকটুক করে বড়ি দিচ্ছে। কায়দা করে আবার বড়ির মুণ্ডুগুলো উঁচু করে দিছে !! হুঁহ, হাতিঘোড়া গেলো তল, মশা বলে কতো জল। হিংসে করে এসব ভাবলাম কারণ মনে পড়ে গেলো সুদূর অতীতে আমি একদা বাড়ীতে বড়ি দিয়েছিলাম। সেই বড়িগুলো দেওয়ার খানিকক্ষণ পরেই কেমন কনফিডেন্স হারিয়ে নেতিয়ে পড়েছিল। সবকটার নাক আমার মতনই বোঁচা হয়ে গেছিলো !! সেই বাতাসা-বড়িগুলো খেতেও জুত হয়নি !! তারপর থেকে আর এসব গোলমেলে কাজে হাত দিইনি। এদিকে হায়দার আলির বড়িগুলো তো দিব্যি দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখছি। ছবি তুলে চুপি চুপি দেখছি, বলতে নেই, এবারে একটু সামান্য গিল্টি-গিল্টি ফিলিং হচ্ছে। তারপর বড়ি দেওয়া হল দুই ট্রে ভর্তি করে। লজ্জার মাথা খেয়ে দেখলাম শয়তান বড়িগুলো সব সুন্দর পিরামিডাকৃতি হয়েছে। তেনাদের কারিগরের মতনই উন্নাসিক। একটাও দেবে যায়নি !! সেসব বড়ি তারপর চার পাঁচদিন ধরে শুকোলো ও কালকে সবে রেডি টু ইউজ হল। আগেই মরমে মরে ছিলাম। এবারে নিজেকে বল্লাম – অকালকুষ্মাণ্ড, অপদার্থ, অকম্মার ঢেঁকি, গোবরগণেশ, উড়নচণ্ডে, হতচ্ছাড়ি ওঠ এবারে। গতর নাড়িয়ে রান্নাঘরের হাল ধর !! তা গেলাম। গিয়ে রান্নাঘরে ঝড় তুলে একের পর এক নামাতে থাকলাম – সেই বড়ি ও আলু-বেগুন-ডাঁটা দিয়ে সর্ষে ঝাল, সাথে ফাউ হিসেবে নারকেল দুধ- কারিপাতা দিয়ে মাছ, মুড়িঘণ্ট (হায়দার আলি খুব ভালো খায় বুঝলেন), বিউলির ডাল, আলু পোস্ত (ছবি তুলি নাই)। এমনকি সবশেষে হাঁপাতে হাঁপাতে বল্লাম ‘বছর দুয়েক আগে যে কাস্টার্ড পাউডার কিনেছিলাম সেটা বের করো, ফ্রুট কাস্টার্ড বানাতে চাই’। এইখানে হায়দার মুচকে হেসে বলল ‘ক্ষ্যামা দিন মা জননী, আর একদিনে অত কায়দা করতে হবে না, যথেষ্ট হয়েছে।’ এরকম সনির্বন্ধ অনুরোধ ফেলতে পারি না বলেই তো আমার আর সুগৃহিণী হয়ে ওঠা হয়না। কি অন্যায়!! পুনশ্চ : বড়িগুলো মারকাটারি হয়েছে, এরপর থেকে যদি এই ব্যাবস্থাই বহাল থাকে – অর্থাৎ বড়ি দেওয়ার ব্যাপারটা ওনাকে দিয়েই করানো যায় তাহলে আর কোন চিন্তাই থাকবে না। আমি শিল্পীকে তার যোগ্য সম্মান দিতে জানি, হুঁ হুঁ বাবা।

Rotimatic

অন্যান্য অনেক রান্নার মতন রুটি বানাতেও আমি পারিনা। বহুবার বহু বন্ধু/বান্ধবী, মা, জেঠিমা, কাকিমা, রান্নার দিদি, এমনকি পাড়ার রুটির ঝুপড়ি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করেও বাড়ী এসে সঠিক কায়দাটা রপ্ত করতে পারিনি। উত্তর ভারতে দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে সেখানকার ঘরে ঘরে তৈরি হওয়া অসামান্য সব রুটি আর পরটার সাথে পরিচিতি রয়েছে। পাঞ্জাবী বন্ধুদের বাড়ী থেকে আনা পরোটা ভোরবেলা তৈরি হয়েও লাঞ্চের সময় অব্দি নরম আর খাস্তা থাকতো। হৃষ্ট-পুষ্ট একটু পোড়া দাগ ওয়ালা চাপাতি কিম্বা সাদা ফুলকা, যাই হোক না কেন, সব নরম আর সুস্বাদু। বীকানিরে শহর থেকে অনেকটা দুরে রাস্তার ধারে এক ছোট্ট দোকানে খেয়েছিলাম পাঁপড়ের মতন মুচমুচে গরম রোটি আর ফুলকপির তরকারি। জেঠিমা শিখিয়েছিল রুটি বেলার পর খানিকক্ষণ সেগুলোকে হাল্কা গরম জলে ভেজানো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়, তাতে খুব নরম রুটি হয়। মা শিখিয়েছিল রুটির ওপর হাল্কা ব্লিস্টার দেখা দিলেই ওগুলো তারজালিতে ফেলে ফলাতে হবে, বেশিক্ষণ তাওয়ায় রেখে সেঁকলে শক্ত হয়ে যাবে। বড় পিসি বলেছিল আটা মাখার সময়ে সামান্য গরম দুধ মিশিয়ে মাখলে রুটি নরম থাকবে। হিমাচল প্রদেশের এক বন্ধু শিখিয়েছিল রুটি বেলার সময়ে বেশী ‘পালথান’ না দিতে। অর্থাৎ বেলার সময়ে বেশী শুকনো আটা না মাখাতে, তাতে রুটি শক্ত হয়ে যায়। তার রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে দেখি সে পটাপট মিনিট দশেকের মধ্যে গোটা তিরিশেক ছোট ছোট চাপাতি বেলে ফেললো। তারপর সেঁকা। ফ্রিজ থেকে বের করা ঠাণ্ডা আটামাখা দিয়ে বানানো সেই চাপাতিগুলো প্রতিটা অসাধারণ নরম হয়েছিলো, এমনকি ঠাণ্ডা হয়ে যাবার খানিকক্ষণ পরে অব্দি নরম ছিল। বাবা কাজের জন্যে বেশীরভাগ সময়ে বাইরে থাকতো, তখন শীতকালে কোনও কোনোদিন রাতেরবেলা মা আমাদের দুই বোনকে রুটি কিনতে পাঠাতো। স্টেশানের এপারে, সারি সারি রুটির ঝুপড়ি দোকান ছিল। সেখানে কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম ছোটখাটো চেহারার ভদ্রমহিলা রোবটের গতিতে ঝপাঝপ রুটি বেলে ফেলছে বিশাল এক উনুনের ওপর চাপানো ততোধিক বিশাল তাওয়ায়। আঁচ গনগন করছে, গরমে ঘেমে নেয়ে স্নান করেও মাসী রুটি বেলা, সেঁকা আর আশ্চর্য টাইমিং বজায় রেখে তাওয়ায় বসানো দশ-বারোটা রুটি পর্যায়ক্রমে ওলটানোর কাজ অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে করছে একা হাতে। একপাশে দাঁড়িয়ে একজন পাঁজা পাঁজা রুটি প্যাক করছে অপেক্ষমাণ খদ্দেরের চাহিদা মতন। সবসময়েই সেখানে অন্তত জনাকুড়ি কাস্টমারের ভিড় লেগেই থাকতো। এই অতি দ্রুত কর্মকাণ্ডে ঘূর্ণিঝড়ের মতন আটার গুঁড়ো উড়ছে চারদিকে, গরম রুটির গন্ধে ম-ম করছে আশপাশ আর হ্যাঁ, প্রতিটা রুটি পাতলা, নরম, শুধু-শুধু খাওয়া যায় এমন সুন্দর। তা, এতো জায়গায় এতো রকম প্রশিক্ষণ পেয়েও আমার রুটিগুলো অবাধ্যর মতন হয় শক্ত হয়ে যায়, নয়তো বেশী নরম, হয় কম্বলের মতো মোটা হয়ে যায় নয়তো চাঁদনীর শ্রীদেবির শাড়ির মতন ফিনফিনে, হয় কাঁচা থাকে নয়তো পুড়ে ঝামা। সে বিতিকিচ্ছিরি ক্যাডাভ্যারাস কাণ্ড। তাই আমি রুটি বানানোর চেষ্টাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। লুচি পরোটায় ফার্স্টক্লাস হলেও রুটিতে পুরো ক্যালাস। শেষমেশ হতাশ হয়ে, এই জিনিশ কেনা হয়েছে। এর বাজারি নাম ‘রোটিম্যাটিক’ (Rotimatic)। আদতে রুটি বানানোর মেশিন। এর মধ্যে নির্দিষ্ট খোপে আটা, জল আর সামান্য তেল দিয়ে সুইচ অন করে দিলেই নিজের গতিতে মাখা-বেলা-সেঁকা হয়ে খানিক পরে রুটি বেরিয়ে আসে। স্টেশান রোডের মাসীর স্কিলের সিকির সিকি ভাগ্যের ধারেকাছে না আসতে পারলেও আমার মতন অকম্মার হেঁশেলে খুব কাজ দিচ্ছে। একটা কথা না বললে ভালো দেখায় না – বাড়ীতে দুইজন রুটি খেতে ভালবাসে, তার মধ্যে আমি নেই। অতএব গোড়ার দিকে আমি রুটি বানানোর ব্যাপারটা বাপ-ব্যাটাকে আউটসোর্স করে দিতে চেষ্টা করেছিলাম। কর্তার কাছে বহুবার গল্প শুনেছি যে তেনারা যখন টিনেজার, তখন রাতের বেলা দুই ছেলে আর তাঁদের বাবার জন্যে অন্ততপক্ষে খান পঞ্চাশেক রুটি বানাতে প্রত্যহ মায়ের ঘাম ছুটে যেত। তাইজন্যে তারা দুজন মাকে সাহায্য করতেন। একজন আটা মাখতেন, একজন বেলতেন। সুতরাং তেনার দাবী তিনি রুটি বানানোতে সিদ্ধহস্ত। তবে দুঃখের বিষয় যতবারই ওনার বানানো ‘রাস্টিক রুটি’ খেয়েছি ততবারই হাতের জল শুকোতে চায়নি। বয়েস তো হচ্ছে, তাই আর ঝুঁকি না নিয়ে শেষমেশ এই সিদ্ধান্ত। 😃

গ্র্যাজুয়েশান

ছবিগুলো এমনিই দিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু পিছনে তাকিয়ে দেখছি সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে এলাম এই ক’দিনে। অতএব আবেগের বশে এখন মেলা বকবক করবো, সেসব না পড়লেও চলবে 😞 জীবনে খুব কম কাজ সিরিয়াসলি করেছি। এর জন্যে পরে পাহাড়প্রমান নিষ্ফল আক্ষেপ জমা হয়েছে। যে সময়ে সব ভুলে মন দিয়ে শুধু কেরিয়ার করা উচিত ছিল সে সময়ে অর্থহীন বিষয়কে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে সুযোগগুলো পেয়েও পেরিয়ে গেছি। সব দেশে শিক্ষাব্যাবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদের কমবেশি লেবেলিং করে দেওয়া হয়। সে যতই ন্যায্যতার কথা আওড়ানো হোক না কেন। বরাবরের ফাঁকিবাজ আমি ছোটবেলা থেকে ‘পড়াশোনায় ভাল’ লেবেল খানিকটা অনায়াসে পেয়ে গিয়ে যাকে বলে ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ করে ফেলেছিলাম। আমার শিক্ষকরা জানেন খুব একটা মন দিয়ে পড়াশোনা করিনি, অন্তত এম এসসিতে ঢোকার আগে পর্যন্ত। তাতে ‘ভাল ছেলেমেয়ে’দের দলে থেকে যেতে কোনও অসুবিধা হয়নি। এইরকম ফাঁকিবাজের কপালেও টেন টুয়েলভে ফার্স্ট ডিভিশান (তখনকার হিসেবে বেশ ভালই নম্বর ছিল) আর বি এসসি, এম এসসিতে ফার্স্ট ক্লাসের শিকে ছিঁড়ে গেছিলো। এরপর শুরু হল আসল খেলা। আগেই বলেছি, খুব একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলাম না। তবে বাড়িতে দুই মাসি, দুজনেই শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। তার মধ্যে আবার ছোটমাসি জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষিকা। মামাবাড়িতে বহু গরমের ছুটির দুপুর কাটিয়েছি চুপিচুপি কুট্টির বুকশেলফের অজস্র জীবনবিজ্ঞানের বই ঘেঁটে, তারই শাড়ি পরে গামছা দিয়ে লম্বা বিনুনি করে (এখনও কুট্টির কোমর ছাপানো লম্বা চুল) টিচার-টিচার খেলে। ক্লাস টেনে ওঠার পর থেকে দেখলাম নিচু ক্লাসের বাচ্চাদের বাবা মায়েরা তাদের গৃহশিক্ষক হিসেবে আমাকে বেশ সাদরে ডাকাডাকি করছেন। হাতখরচার এরকম সুযোগ কেউ ছাড়ে! পরে অবশ্য বাবা-মায়ের আপত্তির জন্যে (নিজে পড়বি কখন রে) এগুলো ছাড়তে হলো। এমনকি বোন যখন টুয়েলভে উঠলো, দেখা গেলো সে অঙ্ক, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি প্রভৃতিতে খুব চৌখস, কেবল বায়োলজির জেনেটিক্সটা তাকে একটু দেখিয়ে দিতে হবে। আমাকে বলেছিল, কিন্তু আমি পাত্তা দিইনি (ছোটদের একটু রেলা দেখাতে হয় সবসময়ে)। অতঃপর পত্রপাঠ ওপরমহলে গিয়ে নালিশ জানানোয় বাবা জানতে চাইলো এসব কি অভদ্রতা। অল্প ঘ্যাম দেখিয়ে জানালাম কিঞ্চিত সম্মান দক্ষিণা দিলে বোনকে জেনেটিক্স পড়িয়ে দিতে রাজি আমি। এভাবেই নানারকম কুচো-ধাড়ী-মাঝারি ছাত্রছাত্রী পড়াতে পড়াতে কাজটাকে রীতিমতো ভালবাসতে শুরু করে দিলাম। প্রথম ভালবাসা যদি হয় বিজ্ঞান তাহলে, দ্বিতীয় অবশ্যই, অবলা প্রাণীকে বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া। পড়ানো ছাড়া অন্য কিছু করার কথা জীবনে কোনোদিন ভেবে উঠতে পারিনি। পড়ানোর দুটো সুযোগ – স্কুল অথবা কলেজ। আমার এখনও সবথেকে পছন্দ হাইস্কুল, তা সত্ত্বেও প্রোফেসরদের কথায় আর বাকী বন্ধুদের দেখাদেখি নেট দিলাম। যদিও পরীক্ষা বেশ ভালোই দিয়েছিলাম, তাও আশা করিনি যে একবারেই পেয়ে যাবো। তবুও পেলাম। বাড়ীতে বেশ কিছুদিন ভিআইপি ট্রিটমেন্ট জুটল। ওই পর্যন্তই। নেটের সার্টিফিকেট সেই থেকে ল্যামিনেট করে তুলে রাখা আছে। এদিকে নিজে পড়েছি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে। কেভিতে পড়াতে গেলে পরীক্ষা তো দিতেই হবে আর লাগবে বিএড। আমার অনেক বন্ধুরা ইতিমধ্যে বিএড পড়তে শুরু করে দিয়েছে। আমার আবার আর্টসের সাবজেক্টে ভীষণরকম ভীতি। একেবারে দুঃস্বপ্ন যাকে বলে। আর যাই হোক, কিছুতেই বিএড পড়তে পারবো না। অন্য উপায় দেখতে হবে। কে না জানে পশ্চিমবঙ্গে বহু বছর শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের ক্ষেত্রে খুব একটা স্বচ্ছতা ছিলোনা (বাবার বন্ধু প্রিন্সিপাল/ওই স্কুলেই পড়েছি ও সকলের প্রিয়পাত্র/অমুক পার্টির স্নেহধন্য ইত্যাদি)। অবশেষে, সেই সময়ে কয়েক বছর আগে থেকে শুরু হয়েছিলো স্কুল সার্ভিস কমিশান পরীক্ষা। এর মাধ্যমে সরকারী স্কুলে অন্তত মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হচ্ছিলো। সুতরাং দাদা/কাকা/মামা কাউকে না ‘ধরলে’ও হাইস্কুলের চাকরীগুলোতে ন্যায্য প্রতিযোগিতার ব্যাবস্থা ছিল। তাই বসলাম এসএসসিতে। এখানে বলে রাখা দরকার আমাদের সময়ে একটা গুজব খুব শোনা যেত – সিবিএসই থেকে ১২ পাশ করলে নাকি কলেজে ভর্তির সময়ে কুড়ি পারসেন্ট নম্বর কেটে নেওয়া হয় !!! এইরকম আক্রোশমূলক গুজব কে ছড়িয়েছিল জানিনা, তবে কলেজে ভর্তির আগে খুব ভয় করেছিলো। বেশি জায়গায় ফর্ম তুলিনি। তার মধ্যে ব্রেবোর্ন, বেথুন আর পাড়ার কলেজ বিকেসিতে (এটা প্ল্যান বি হিসেবে রাখা ছিল) নাম উঠলো। আসাম থেকে এসে কলকাতার রাস্তাঘাট কিছুই চিনিনা, অতএব তুলনামুলকভাবে কাছাকাছি বেথুনে ভর্তি হয়ে গেলাম। প্রাণ ভরে মাইক্রোবিয়াল জেনেটিক্স পড়ার সুযোগ এলো বটানিতে। জুলজিতে জেনেটিক্স বেশী পড়ানো হত না, হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট তখনো শেষ হয়নি। ও হ্যাঁ, নম্বর-টম্বর কিছু কেটে নেয়নি, আলাদা বোর্ডের আলাদা ইভ্যালুয়েশান সিস্টেম ছিল। তা, এই গুজব এসএসসি দেবার সময়েও মনে পড়ে বেশ ভয় লেগেছিল, খাটাখাটনি করে পাওয়া নম্বর ঘ্যাঁচ করে কেটে নেওয়া কি চাট্টিখানি কথা !! সে যাই হোক, আবার দেখা গেলো – আশঙ্কা অমূলক। রিটেনে নাম উঠল, তারপর দিতে হবে ভাইভা। এটা শুনলাম বেশ কঠিন। বাবার সঙ্গে নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে হাজির হলাম স্কুল সার্ভিস কমিশানের অফিসে। আমার নাম ডাকা হলে দুরুদুরু বক্ষে ঢুকে দেখি আরও কয়েকজন অচেনা মানুষের সঙ্গে প্যানেলে বসে রয়েছেন আমাদের ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্টের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ডঃ সুমিতা ঝা। উনি আবার আমারই স্পেশাল পেপার – মলেকিউলার বায়োলজি, সাইটোজেনেটিক্সের প্রোফেসর। দেখেই হাত-পা পেটে সেঁধিয়ে যাবার উপক্রম। সে যাক, উনি অবশ্য একটুও ভয় দেখানোর চেষ্টা করেননি দেখে সাহস ফিরে পেয়ে ভালই ভাইভা দিলাম। এদ্দিন বাদে আর বিশেষ মনে নেই, তবে বেশিরভাগ ছিল সাবজেক্টের প্রশ্ন, কয়েকটা প্রশ্ন পড়ানো নিয়ে। এখনকার মতন তখন র‍্যাঙ্কের ভিত্তিতে বাড়ীর কাছে স্কুলে পোস্টিং হওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই মেধা তালিকাতে দ্বিতীয় স্থানে নাম থাকলেও আমি চাকরী পেলাম খিদিরপুরের এক গার্লস হাইস্কুলে। ততদিনে আবার দিল্লীতে চলে গেছি আমি। চাকরি করার জন্যে বেলঘরিয়ার বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করলাম। রোজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়ে সাতটায় স্কুলে হাজিরা। আমি ট্রেনে যাতায়াতে স্বচ্ছন্দ নই তেমন, ওঠা-নামা করতে খুব ক্যাবলা হয়ে যাই তাই যেতাম বাসে। মেলা সময়ের শ্রাদ্ধ। স্কুলে বেশ ভাব হয়ে গেলো বাকি সকলের সঙ্গে। ক্লাসের মাঝে গল্পস্বল্প হত অল্পবিস্তর। আগেই বলেছি আমার জীবনে কিছুই মসৃণভাবে হয়না। সুতরাং শিগগিরই কাহানী মে টুইস্ট এসে গেলো। ইতিমধ্যে আমি এক ভুলভাল সম্পর্কে ঢুকে পড়েছি এবং সবেমাত্র কুয়াশাগুলো কাটতে শুরু করেছে। প্রত্যাশিতভাবেই দুরে থেকে চাকরী করা নিয়ে আমাকে নানা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ দেওয়া হতে থাকলো। অত পরিশ্রম করে পাওয়া সরকারী চাকরী কি হাতের মোয়া যে ছেড়ে দেবো অমনি? কিছুতেই কিছু হলোনা। ছেড়ে দিলাম। দিল্লীতে ফেরার পর প্রথমে ভাবলাম পিএইচডিতে ঢুকি যেমন সবাই করে। কয়েকদিন জামিয়াতে এক প্রোফেসরের কাছে যাতায়াত করতে করতেই হঠাৎ চাকরী পেলাম মোটামুটি নামকরা এক পাবলিশিং হাউসে – এস চাঁদ টেকনোলজিস। দিল্লীতে তখন সবে রমরমা শুরু হচ্ছে এমন একটা ইন্ডাস্ট্রির যেটা এখন সারা পৃথিবীতে জলভাত, ই-লার্নিং। কাজটা হলো, হাই স্কুলের (১০-১২) বায়োলজির অনলাইন ‘কন্টেন্ট ডেভেলপ’ করতে হবে। মানে একরকম ডিজিটাল বই লেখা আর কি। বেশ কিছু ই-লার্নিং কোম্পানি তখন নাম করতে শুরু করেছে। ঢুকে গেলাম। পয়সাকড়ি ভালই। বিভিন্ন বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী কনসেপ্ট ধরে ধরে গোটা একটা ই-বুক লেখার কাজ। সাবজেক্ট টিম কন্টেন্ট লিখবে আর জায়গামতন জুতসই অ্যানিমেশানের বা ইন্টের‍্যাক্টিভের স্টোরিবোর্ড লিখে রাখবে। এরপর সেটা যাবে মাল্টিমিডিয়া টিমের কাছে (এক-একটা সাবজেক্টের আলাদা টিম) তারা স্টোরিবোর্ড দেখে অ্যানিমেশান বানিয়ে গোটা ব্যাপারটা ডিজিট্যাল কন্টেন্টের রূপ দেবে। ফাইনালি একবার দেখে দিতে হবে, তারপর সেটারই অডিওবুকও তৈরি হবে রেকর্ডিং রুমে। বায়োলজির বেশ বড় টিম। পাশে কেমিস্ট্রি বসে। খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেলো সকলের সঙ্গে (এখনও বন্ধুত্ব টিকে আছে অনেকের সাথে)। কাজটা বেশ ভালবেসে ফেললাম। এস চাঁদ দিয়ে শুরু করে চুটিয়ে কাজ করে এখানে আসার আগে অব্দি এক্সট্রামার্ক্সে ছিলাম। এখনো কিছু বন্ধুর সাথে নিয়মিত কথাবার্তা হয়। ইতিমধ্যে জীবনে এসে গেছেন শ্রীমান মিত্তিরমশাই। রোজ দুজনের চাকরীর মোট রাস্তা প্রায় ১০০ কিলোমিটার যাতায়াত করে, নিত্যই সিনেমা দেখে, বাইরে খেয়ে, উইকেন্ডে গাড়ি নিয়ে কাঁহা-কাঁহা মুল্লুকে টোটো করে ঘুরে বেড়িয়ে দুর্দান্ত কাটছিল দিনগুলো। মানসিক অবসাদ কাটিয়ে নিজেকে ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছিলাম আবার। ক’দিন পরে তল্পিতল্পা গুটিয়ে এসে পড়লাম এখানে। ব্যাস, কাজকর্ম শিকেয় উঠলো। সোমবার যখন আমাকে টাটা করে অরি অফিস চলে গেলো, তখন আচমকা বাস্তবটা ধাঁই করে লাগলো এসে পাঁজর ঘেঁষে আর কি। কিন্তু তখন হাত পা বাঁধা, আমার চাকরী করার কাগজপত্র নাই। পরের বছর এসে পড়লেন শ্রীমান ছোট মিত্তির। ব্যাস, ষোলকলা পূর্ণ। তেনাকে একটু সাব্যাস্ত করে দিয়ে বেশ ক’বছর পর আবার মাঠে নামতে গিয়ে দেখি এদেশে পাবলিক হাইস্কুলে পড়াতে গেলে টিচিং ক্রেডেনশিয়াল লাগে। সেটা একটা বিরাট লম্বা ও দুরূহ ব্যাপার। এমনিতে ছোটোখাটো দুধভাত টাইপের একটা কোর্স করলে এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ানো যায়। অবশ্য প্রাইভেট স্কুলে যেকোনও গ্রেড লেভেল পড়াতে গেলে ওসব লাগেনা। সেখানে বিচার্য হয় ডিগ্রি আর বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান। ভাবলাম, কে এখন ক্রেডেনশিয়াল করতে যাবে। তাই পরীক্ষা, ইন্টার্ভিউ যথাবিহিত পার করে ঢুকলাম প্রাইভেট স্কুলে। প্রাইভেট আর পাবলিক স্কুলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে মস্ত তফাৎ। ছাত্রকুলের আসল বৈচিত্র্য আর জনসংখ্যার প্রতিরূপ দেখতে গেলে পাবলিক স্কুলে যেতে হবে। অতএব কয়েক বছর সেখানে পড়িয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। সিঙ্গেল সাবজেক্ট টিচিং ক্রেডেনশিয়াল করতে হবে। আগেই বলেছি, অত্যন্ত প্যাঁচালো পথ। প্রথমে দিতে হল গাদা গুচ্ছের পরীক্ষা। জেনারেল সায়েন্স, সাবজেক্ট পরীক্ষা, ইংলিশ পরীক্ষা, তার ওপর আবার বিদেশী ছাত্র বলে আমাকে কিছু এক্সট্রা পরীক্ষা দিতে হল। এখানে দু তিনটে ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হয়। স্যান হোসে স্টেটের প্রোগ্র্যাম দু’বছরের, প্রথম বছর পড়া, দ্বিতীয় বছর পড়ানো। আর তেমন ভালো রিভিউ শুনিনি। পড়ে রইলো স্ট্যানফোর্ড আর স্যান্টা ক্লারা ইউনিভার্সিটি। দুটোরই এই প্রোগ্র্যামের বেশ নামডাক, আর সবথেকে বড় কথা – এক বছরের মধ্যে ফুলটাইম পড়ে শেষ করার ব্যাবস্থা আছে। ঢোকার পরীক্ষাগুলোতে পাস করা ছাড়াও কয়েক বছরের এক্সপেরিয়েন্স লাগবে আর লাগবে মাস্টার্সে ৩.৫ এর ওপর জিপিএ। এদেশে পড়াশোনার ক্ষেত্রে এই জিপিএ মন্ত্রে অনেক বন্ধ দুয়ার খোলে। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে মন দিয়ে পড়াশোনা করার একটা সুফল এতদিনে পাওয়া গেলো। ইভ্যালুয়েট করানোর পর দেখা গেলো আমার রয়েছে ৩.৯ জিপিএ। রচনা লিখে অ্যাপ্লিকেশান জমা দিয়ে বসে রইলাম। টানটান সাসপেন্সের পর একদা অ্যাকসেপ্টেন্স এর চিঠি এলো। ক্রেডেনশিয়ালের জন্যে আমাকে এক বছরের মধ্যে (সর্বাধিক দু বছর) কমপ্লিট করতে হবে MEd, মোটামুটি সাতশো ঘণ্টার নিরীক্ষিত টিচিং এবং CSET, CBEST পরীক্ষার স্কোর। পরীক্ষা দুটোর স্কোর আগেই দিয়েছিলাম। জয়েন করার পরে দেখলাম সিংহভাগ সহপাঠী তখনও লড়ে যাচ্ছে, অনেকেই পাস করে উঠতে পারেনি, এক বছর সময় থাকে স্কোর জমা দেবার। এছাড়া, যা আগে জানতাম না ঢোকার পর জানলাম, তা হল CalTPA নামক উৎকট কঠিন, হাজারো রকম বিশ্লেষণ, প্রতিফলন, ভিডিও ইত্যাদি সমৃদ্ধ বিপুলায়তন এক নিবন্ধ/তত্ত্বালোচনা শেষ করে জমা দিতে হবে মোট দু’বার। এখানেই অধিকাংশ উইকেট পড়ে শুনলাম। আর কি করা, খেলতে নেমে এখন আর মাঠ ছাড়লে চলে না। ১৮টা কোর্স, ৫০ ইউনিট (এক ইউনিট দশ ঘণ্টা) আর এই ক্যাল্টিপিএ। অন্যান্য স্টেটের তুলনায় এই ক্যালিফোর্নিয়াতে হাইস্কুলের ক্রেডেনশিয়ালিঙে এতো বড় বাঁশ দেওয়ার ফল প্রতিনিয়ত পায় প্রশাসন। এখানে শিক্ষকের মস্ত আকাল। এখন ঢোকার পরীক্ষাগুলো অন্তত কম করে দেবার কথা ভাবা হচ্ছে। সে যাকগে, বহু যুগ পর আবার ছাত্রাবস্থায় ফিরে বেশ একটু মজাই লাগছিলো। অচিরেই শখের প্রাণ গড়ের মাঠ হল যখন দেখলাম এখানে পোস্ট গ্রাজুয়েট পড়ার সাথে দেশের একদম মিল নেই। সকালে ক্লাসে পড়ানো আর বিকেলের পর নিজের ক্লাসে পড়া। প্রতিদিন গড়ে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত পড়া ও পড়ানো আর তার ওপর পড়ার চাপ। কয়েক সপ্তাহে মোটামুটি হাড়ে-হাড়ে বুঝলাম যাকে বলে – হোয়াট হ্যাভ আই গটেন মাইসেলফ ইনটু। প্রতিটা ক্লাসের জন্যে আগে থেকে ন্যুনতম ৩০-৫০ পাতা পড়ে যেতে হয় (মেলা বই কিনতে হল) সঙ্গে প্রেজেন্টেশান বানাতে হয়, পাতার পর পাতা লিখতে হয় (এইজন্যেই আর্টস পড়তে এতো ভীতি আমার)। এসব না করলে নম্বর তো পাওয়া যাবেইনা, এমনকি ক্লাসে প্রোফেসররা যা পড়াবেন তারও কিছু বোঝা যাবেনা। প্রায়শই মাত্র দশ নম্বরের জন্যে ১০-১২ পাতা লিখতে হয়েছে !!! অনন্ত পড়া, তত্ত্বকথা আলোচনা, বিশ্লেষণ লেখার মধ্যে দিয়ে একটা ব্যাপার হচ্ছিল। ভারতের সাথে এদেশে পড়ানোর ট্রেনিঙের আকাশ পাতাল তফাতটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল। এখানে পাবলিক স্কুল ডিসট্রিক্টে শিক্ষাপদ্ধতির যে পরিমাণ গবেষণা, ফান্ডিং, আধুনিকীকরণ ক্রমাগত চলতে থাকে তার সঙ্গে খুব কম দেশের তুলনা করা যায়। প্রতি পদে যেমন নতুন জিনিস জানছিলাম আর শিখছিলাম তেমনই অনেক কিছু যাকে বলে ‘আনলার্ন’ করতে হচ্ছিলো। প্রতিদিন দুই থেকে তিনটে ক্লাস, প্রতিটা তিন ঘণ্টার। এর সাথে সকালে পড়ানো, তার আনুষঙ্গিক সমস্ত দায়িত্বসহ। অচিরেই দেখলাম নিজের জন্যে আর পরিবারের জন্যে কিছুমাত্র সময় অবশিষ্ট থাকছেনা। কাছের বন্ধুরা জানে গত এক বছর কিরকম কেটেছে আমার। একটা শনি-রবিবারেও কোথাও যেতে পারিনি, কারুর সঙ্গে কথা হয়নি, মুখ গুঁজে শুধু কাজ আর পড়াশোনা করতে হয়েছে। এই কাজটা আমাদের ২০-২২ বছর বয়েসী সদ্য কলেজ পাস করা সহপাঠীদের পক্ষে যতটা সহজ ছিল আমাদের মতন মুষ্টিমেয় ক’জনের পক্ষে অতটা সহজ ছিলোনা। এক এক সময়ে বাড়ীর লোকের সঙ্গে হুঁ-হ্যাঁ ছাড়া একটা কথাও বলতে পারিনি টানা এক-দুই সপ্তাহ। তবে এই পুরো বছরটা যাদের ক্রমাগত মানিয়ে নেওয়ার জন্যে শেষরক্ষা হয়েছে তারা হলেন বাড়ীর দুই শ্রীমান। বড়মিত্তির ও ছোটমিত্তির। ছোটজন মাঝে লাগামছাড়া হয়ে একটু বিপথে যাওয়ার চেষ্টা করলেও যার কাছে আমি এই জন্মের মতন ঋণী থাকলাম সে হল অরি। দিনের পর দিন এমনকি খাবার বেড়ে মুখের কাছে এগিয়ে পর্যন্ত দিয়েছে। আমার ওঠার সময়টুকু হয়নি। এইসব করতে করতেই এসে পড়লো কুখ্যাত CalTPA cycle 1। ওরে বাবা, সেকী সাঙ্ঘাতিক বড় একটা কাজ !! চোখে সর্ষেফুল দেখলাম। যাই হোক, মেলা খেটেখুটে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে একবারেই উৎরে গেলাম। দ্বিতীয় সাইকেলে ভাবলাম এ আর এমন কি, একবার তো পেরেছি। ও বাবা, পরেরবারের কাজ প্রথমবারের থেকে প্রায় দশগুণ বেশী আর রুব্রিকও অনেক বেশী। যাই হোক, খাবি খেতে খেতে আর নিজেকেও অবাক করে এটাও প্রথমবারে উৎরে গেলাম। এরপরের গল্প সংক্ষিপ্ত। কয়েকমাসের মধ্যে এতো খাটাখাটনির ফল হাতে নাতে পাওয়া গেলো। মোট ৪.০ জিপিএ নিয়ে পাশ করা গেলো। যার জন্যে এতো লেখা – এদেশে গ্র্যাজুয়েশান একটা বিরাট ব্যাপার। এমনকি প্রায় হামাগুড়ি দেওয়া বাচ্চাদেরও কিন্ডারগার্টেনে ‘গ্র্যাজুয়েশান’ হয়। সে একটা উৎসবের মতন ব্যাপার। আমার অনেকদিনের শখ ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাটায়ার’ পরা ছবি হবে। তা, দেখলাম ধরা চুড়ো দেবে আমাদের। আসল কমেন্সমেন্ট হবে ভার্চুয়ালি, আর তার আগের দিন একটা প্যারেড হবে। সেই প্যারেডে যাওয়ার জন্যে সকলে প্রচণ্ড উত্তেজিত দেখলাম। প্রথমে যাবো বলেও, পাঁচশোর ওপর মানুষের ভীড়ে টিপুকে নিয়ে যাওয়ার সাহস পেলাম না। তবে সেইদিন প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে গাদা গাদা ছবি তুললাম। সব শেষে নিট ফল, পুরনো দিনের মানুষের মতন বলতে পারবো ‘আমি ডবল এম-এ’ , তার মধ্যে একটা এমএস এই যা তফাৎ। আরেকটা পাওনা, হাজার ঝামেলার মাঝেও দুই, থুড়ি – তিন বুড়োবুড়ির ফোগলা হাসি আর উত্তেজনা। এই হাসিমুখগুলো পাশে থাকলে অনেক কিছু করতে পারি। Happy Father’s Day Baba- this one’s for you. এতক্ষণ ধৈর্য ধরে এই বকবকানি পড়ার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আর কিছু না হোক ধান ভাঙতে গিয়ে শিবের লঅঅঅঅম্বা গীত গাওয়ার অভ্যেসটা এই ক’দিনে বেশ পাকাপোক্ত হয়েছে দেখতে পাচ্ছি। Translation – Don’t let anybody tell you otherwise, if you believe in yourself, just give it a shot, everything else will fall in place. Two master’s degrees in my bag. Phewh!