হাত বাড়ালেই …

গরমের ছুটিতে প্রায় প্রত্যেক বছর আমরা কৃষ্ণনগরে দাদু-ঠাকুমার বাড়ি বেড়াতে যেতাম। ছুটি মানে, প্রাইমারি ইশকুলে পড়ি, পড়া না পড়া সমান। তখন তো আর আজকের দিনের মত পেট থেকে পড়তে না পড়তেই নাচ রে, গান রে, আঁকা রে, ক্যারাটে রে, সাঁতার রে করে বাচ্চার ছোট্ট জীবনকে বিভীষিকাময় করে তোলার রেওয়াজ ছিল না। তাই পুরো গরমের ছুটি মনের সুখে ঠাকুমার হাতের অগুন্তি রকম আচার খেয়ে আর দাদুর বাগানবাড়িতে রোদে রোদে প্রচুর খেলাধুলো করে কাটাতাম ভাইবোনেরা সব্বাই।
আমাদের উল্টোদিকের বাড়িতে এরকম আরেক জোড়া দাদু-ঠাকুমা থাকতেন। তাঁদের নাতি অবশ্য ওই বাড়িতেই থাকত, কৃষ্ণনগর এর ছেলে, রাজু। আমার চেয়ে একটু বড়, তাই আমার রাজু-দাদা। আমি ছুটিতে গেলেই সারাক্ষণের খেলার সঙ্গী ছিলো ওই রাজু-দাদা। সকালে উঠে দাঁত মেজে কোনদিন লুচি-আলু চচ্চড়ি, কোনদিন রুটি-আলুভাজা খেয়ে অপেক্ষা করতাম কখন রাজু-দাদা আসবে আর খেলা শুরু হবে।
বাগান পেরিয়ে আমাদের মূল বাড়িতে ঢুকতে হত। বাগানের পাঁচিলের গায়ে একটা গ্রিলের গেট ছিল। একটু ডিঙ্গি মেরে দাঁড়ালে আমরাও তার খিলের নাগাল পেয়ে যেতাম। তাই রাজু-দাদা এসে নিজেই খিল তুলে ঢুকত। ঠুং করে একটা আওয়াজ হতো। বাড়ীর যেখানেই থাকি ওই ‘ঠুং’ আওয়াজটা কানে গেলেই আনন্দে নেচে উঠতাম, খেলার সময় হয়ে গেল যে !!
সেই অর্থে রাজু-দাদাই আমার জীবনে প্রথম বন্ধু, যখন অত গল্প-গাছা করার বয়েস পাকেনা, বন্ধু মানে শুধুই খেলা আর আচার কিম্বা আমসত্বর ভাগীদার।
আমাদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিলো ‘কন্ডাকটর কন্ডাকটর’ । অর্থাৎ বারান্দায় ওঠার উঁচু উঁচু চার ধাপ সিঁড়ির ওপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে, গ্রিল ধরে, অন্য পা শূন্যে দোলাতে দোলাতে চিৎকার করে ‘শান্তিপুর-শান্তিপুর, পোস্ট অফিস-পোস্ট অফিস, এই রোক্কে, বেঁধে বেঁধে, চ-ও-ও-ও-লোও’ এইরকম বলতে থাকা আর মাঝে মাঝে দেওয়ালে চাপড় মারা। আর হাতে থাকত এক বান্ডিল পুরনো টিকিটের গোছা যা আমরা কেউ বাস এ চড়ে এলেই তার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে যত্ন করে রাখতাম।
খেলতে খেলতে বেলা গড়িয়ে যেতো। একসময়ে রাজু-দাদার বাড়ি থেকে চান-খাওয়ার ডাক আসতো। আবার পরের দিনের অপেক্ষা।
ঐটুকু সময় এমন প্রিয় ছিল আমার, যে পরে অনেক বড় হয়েও ওই ‘ঠুং’ আওয়াজটা মনে পড়লেই কেমন চনমন করে উঠত মনটা। আসন্ন আনন্দের বার্তা বয়ে আনত ওই শব্দটা, মনের গভীরে গেঁথে গেছিলো তার অনুরণন। সেই প্রথম আমার বন্ধু শব্দের মানে বোঝা।
তারপর জীবনে অনেক বন্ধু-বান্ধব হয়েছে। অনেক বন্ধুত্ব ভেঙ্গেও গেছে। ‘বন্ধু’ শব্দটার সাথে যেই আস্থার আশ্বাস থাকে বলে জানি, সেই বিশ্বাস এর জোরে আমি প্রথমেই বন্ধু পেয়ে হ্যাল-হ্যাল করে এক গঙ্গা কথা বলে ফেলি। তারপর দেখি কেউ কেউ সেই কথা গুলোর জের টেনে পরে আমাকেই বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে। তাকে যাই বলা যাক ‘বন্ধু’ আর বলা যায়না কোনমতেই, তাই সেখান থেকে মানে মানে কেটে পড়েছি। ঝামেলাকে আমার ভীষণ ভয়। আরো ভয় আমার নিজের রাগকে। বেচাল দেখলেই দারুন রেগে গিয়ে আমি একেবারে অনর্থ করে ফেলি, তারপর আর কিছুই করার থাকে না। তার আগেই সরে আসা ভালো।
এই করে করে মানুষ চিনতে শিখেছি। এখন আমি প্রথম দেখাতেই মানুষকে মোটামুটি নব্বুই ভাগ পড়ে ফেলতে পারি। বাকিটা ক্রমশ প্রকাশ পায়
রাজুদাদার পরে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলো মিঠু।
অসম থেকে আগত আমি কলকাতার রাস্তা-ঘাট কিছুই চিনতাম না। স্কুলে যেতাম বাসে করে, একদিন স্কুল বাস না এলে কি করে বাড়ি যাব সেই চিন্তায় অস্থির হতাম। অত চালক-চতুর ছিলাম না, বরং একটু ভোঁদাই গোছেরই বলা চলে। এই অবস্থা থেকে কলেজে যাওয়ার সময় এসে গেল। কয়েক জায়গায় নাম উঠলো। দেখলাম ব্রাবোর্ন বলে যে কলেজটা সেটা হচ্ছে সুদুর পার্ক সার্কাস বলে জায়গাটায়, বাড়ি থেকে যাতায়াত করতেই দেড়-দু ঘন্টা। একা-একা বাস এ চড়ে অদ্দুর, বাপরে! অতএব বাতিল। আর নাম উঠেছে বেথুন বলে এক কলেজে। সেটাও শুনলাম বেশ ভালো। সেখানেই ঢুকে পড়া গেল। কারণ একটা বাস এ চড়েই যাওয়া যায়, আটাত্তরের সী।
প্রথমদিনই চশমা পড়া গাল-ফোলা মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ের সাথে বেশ আলাপ জমে গেল কারণ সে আসে পালপাড়া থেকে, ওই একই বাস এ। কোনওদিন বিপদে পড়লে ওর সঙ্গে ফেরা যাবে বলে গরজটা আমারই বেশি ছিলো। এই আমার মিঠু। পাঁচ বছর একসাথে যাতায়াত করে আর ক্লাসে পাশাপাশি বসে আমরা একদম অভিন্নহৃদয় যাকে বলে তাই হয়ে উঠেছিলাম। যেকোনো কথা প্রথমে একে অপরকে না বললে আমাদের ভাত হজম হত না। দুজনের বাড়িতেও দুজনের অবাধ যাতায়াত ছিল। কত কত ছুটির দুপুর আমরা গল্প করে কাটিয়েছি বাড়ির ছাদে, তা গুনে বলা যাবে না। কিছদিনের মধেই কলেজ এ সবাই আমাদের মানিকজোড় বলে ডাকতে শুরু করলো |

যত ঝগড়া করতাম, ততই ভাব ছিলো। জুলজি ক্লাসে একবার ল্যাটা মাছের স্নায়ু-তন্ত্র ডিসেকশন হলো। উরেঃ সে কি গন্ধ মাছের। পাঁচশো বার সাবান দিয়ে হাত ধুলেও গন্ধ যেন আর যায় না। ছুটির পর আমি আর মিঠু প্রায়দিনই ফুচকা খেতাম গেটে। সেদিন হাতের গন্ধর জন্যে একটা ফুচকাও মুখে তুলতে পারছি না। শেষে মিঠু একটা একটা করে ফুচকা খাইয়ে দিল আমাকে।
আরো যে কত ঘটনা আছে। পার্ট টুর আর এক সপ্তা বাকি। দিনরাত পড়ে পড়ে মিঠুর গলা ভেঙ্গে গেছে। আমি বরাবরই আওয়াজ না করে পড়ি, গলা না ভাঙ্গলেও চোখের তলায় কালি পড়েছে রাত জেগে। কলেজ এ আ্যডমিট কার্ড নিতে গিয়েছি দুজনে। ‘তাল’ ছবি এসেছে তখন। ব্যাস, ফেরার পথে দুজনে মিত্রায় ‘তাল’ দেখতে ঢুকে পড়লাম । বাড়ীতে বললাম পরীক্ষা তো তাই দক্ষিণেশ্বর এ পুজো দিতে যাচ্ছি !!
এক্সকারশনে যাওয়া হয়েছে দক্ষিন ভারত। রামেশ্বরমে কি নিয়ে যেন ঝগড়া করে আমাদের কথা বন্ধ হয়ে গেলো! দুপুরে খেলাম না দুজনেই। নিজের নিজের রুম এ বসে থাকলাম গোঁজ হয়ে। টুর ম্যানেজার ডেকে-ডেকে হয়রান, কত বোঝালেন, তাও রাগ যায়না। রাতের মধ্যেই আবার গলায়-গলায় ভাব হয়ে গেল। তখন আবার মিঠুই ওই ম্যানেজার বাবুকে বলে রাত্রে আমাদের দুজনের সমুদ্র দেখার ব্যবস্থা করলো কারণ সকালে যখন সবাই গেছিল, আমরা তখন হোটেলে।
কলেজ এর পর ইউনিভার্সিটি। সেখানেও একসাথে। যাতায়াতের সময় বেড়ে দাঁড়ালো দু ঘন্টা। বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে পালপাড়া অব্দি গল্প করতে করতে যেতাম দুজনে। আর প্রায়দিনই খেতাম স্টপ-ওভারের চিকেন রোল।
বালিগঞ্জে বোটানির চারতলার সিঁড়ি তে একটা চাতাল মতন ছিলো। সেখানে ধুলোবালি, একটা ভাঙ্গা বেঞ্চি পাতা থাকত। কেউ যেত না। আমরা সেখানে দু-তিনজন মিলে প্রায়ই আড্ডা দিতাম।
সুযোগ পেলেই গুজগুজ করে গোপন কথা আলোচনা করা, একসঙ্গে প্রথম নিষিদ্ধ নীল ছবি দেখা, স্নাতকোত্তর পরীক্ষার আগে একসাথে রাত জেগে পড়াশোনা করা, বিরোধী দলের মিটিঙে বাস বন্ধ হলে হেঁটে হেঁটে হেদো থেকে বাগবাজার আসা, আমার সব অভিযানের সঙ্গী ছিল ওই ছোটখাটো চেহারার মিষ্টি মেয়েটা।
মাস্টার্সের পর আমাকে দিল্লি চলে যেতে হলো, ওর সাথে যোগাযোগ বহুদিন ছিল না।
বোনের বিয়ের সময়ে আবার দেখা হলো। ছেলেকে নিয়ে এসেছিলো। ওর মতই ফর্সা গাবলু-গুবলু চটপটে বাচ্চা। দেখতে অবশ্য বিল্টু-দার মতন বেশি। সেই বিল্টু-দা, প্রথমে মিঠুর হার্টথ্রব, তারপর হাজব্যান্ড। বিল্টু-দা কে উৎসর্গিকৃত কত শত কবিতা আর গানের পাঠক ছিলাম এই আমি। দারুন ছবি আঁকত মিঠু, আর কবিতা লিখত খুব ভালো। ওর থেকেই শিখেছিলাম বিভিন্নরকম ক্যালিগ্রাফি। না, আজকালকার চাবি টিপে করা ‘ফন্ট’ নয়, দস্তুরমতন কালী-কলম-কাগজে করা ক্যালিগ্রাফি।
ফেসবুকে অনেক পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি, ওকে পাইনি। (মিঠু আবার ‘পুরোনো’ কে সবসময়ে বলতো ‘পুরাতন’)।
আজকাল বন্ধুত্ব দিবস নিয়ে চারদিকে খুব মাতামাতি দেখি। ফ্রেন্ডশিপ ডে কার্ড বা ফুল না দিয়েও আমাদের বন্ধুত্ব দিব্যি টিকে ছিল, আজ ও আছে। তেমন যোগাযোগ না থাকলেও আমার মনের মধ্যেই আছে ও সবসময়ে, থাকবেও।
আজ অবশ্য বন্ধুত্ব দিবস না। তাতে কি হলো, প্রানের বন্ধুকে মনে করার আবার দিনক্ষণ থাকতে পারে নাকি?

Leave a comment