বাহুবলীর বলি

 

 

হ্যাঁ, তা বলছিলাম প্রতি শুক্কুর-শনিবার করে আমরা দু চারটে ছায়াছবি দেখার চেষ্টা করে থাকি। হ্যাঁ, বাড়ীতেই। জেবনে এখন সময়ের বড় অভাব, তাই খুব বাছাই করা কিছু সিনেমা পত্তর দেখা হয়, বেশীরভাগই বাংলা বা বড়জোর ইংরেজি। হিন্দি বাণিজ্যিক ছবি অনেক বছর হল দেখা ছেড়ে দিয়েছি, কারণ ওই দু ঘণ্টায় জমে থাকা বইগুলো পড়লেও কাজ দেয়।

তা এই সপ্তাহে বাড়ীতে প্রণয় এসেছে, সে আবার হিন্দি সব ছায়াছবি ফার্স্ট ডে, ফার্স্ট শো দেখে থাকে। ছায়াছবি বিশেষজ্ঞ আর কি। তারই প্ররোচনায় শুক্রবার গভীর রাতে আমরা বসলাম বাহুবলী দেখতে। সে বারবার হলফ করে বলল সময় নষ্ট হবেনা মোটেই, এ জিনিস না দেখলে জীবন বৃথা। অমর চিত্রকথা বরাবরই আমার বেশ প্রিয়, বসে পড়লাম সবাই।

ঘর অন্ধকার করে লেপ-টেপ মুড়ি দিয়ে বেশ আয়েস করে বসা গেলো। শুরুতেই দারুণ দারুণ সব সিন সিনারি দেখা গেলো। বিশালকায় উঁচু জলপ্রপাতের ওপার থেকে অসামান্যা সুন্দরী এক রানি টাইপের তেজী মহিলার পিঠে গেঁথে থাকা তীর নিয়েও সাদা লুঙ্গি পড়া, একজন ছোট্ট ও ন্যাড়া বাচ্চাকে কোলে করে একবুক ভয়ানক স্রোতস্বিনী জল ঠেলে সে কি সদর্পে বিচরণ। দেখে তাক লেগে গেলো। এই না হলে মা। পরে শুনলাম সে নাকি ঠাকুমা !! কিছুক্ষণ পরেই তার নাক অব্দি জলে ডুবে গেলো, তবু একটিমাত্র হাতে বাচ্চাকে মাথার ওপর তুলে ধরে সে ওই স্রোতের মধ্যে সটান খাড়া দাঁড়িয়ে থাকলো। দাঁড়িয়েই থাকলো যতক্ষণ না বাচ্চার চিল চিৎকার শুনে আশপাশ থেকে জেলে শ্রেণীর কিছু মানুষ দৌড়ে এসে তাকে উদ্ধার করে। তাকে মানে বাচ্চাকে, রানিমার হাত ছাড়া তো কিছু আর দেখা যাচ্ছিল না। সেই হাত এতক্ষণে হাঁপ ছেড়ে নিশ্চিন্তে সলিলসমাধি বরণ করেন। মৃত্যুর আগে যদিও অঙ্গুলি নির্দেশে সেই সুউচ্চ এভারেস্টতুল্য জলপ্রপাতের ওপারে দেখিয়ে দেন। জেলেদের মধ্যে যে সবথেকে মুখরা ও বড়লোক  মহিলা, সে বাচ্চাকে কব্জা করে সকলকে ধমক দিয়ে প্রপাতের ওপারে যাওয়ার শর্টকাট গুহাপথ পাথর দিয়ে চিরতরে বন্ধ করে দেয়। বড়লোক বুঝলাম কি করে – তার হাতে – পায়ে – কানে ও গলায় ভারী ভারী চমৎকার কাজ করা রুপোর সব গয়নাগাটি ছিল, এর এক সেট পেলে বে এরিয়াতে দুর্গা পুজোয় সাড়া পড়ে যেতো।

এরপর আর কি, সেই বাচ্চার নাম দেওয়া হয় শিবু এবং সে নিজের জন্মসূত্রের অমোঘ টানে, বড় হওয়ার বিভিন্ন ধাপে প্রায় রোজ একবার করে খাড়াই পাথরের দেওয়াল ডিঙ্গিয়ে জলপ্রপাতের ওপারে যাওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে। খালি হাতে পিচ্ছিল পাহাড় গাত্রে তার ডিগবাজি দেখে বারংবার পিলে চমকে উঠতে থাকে দর্শকের এবং তার মায়ের। সুতরাং তার মা এবারে তাকে আটকানোর জন্যে এক আরবিট সাধুকে ধরে এনে শিবের পুজো/ যজ্ঞ করতে থাকে। শিবকে সন্তুষ্ট করতে মা ঘড়া ঘড়া জল তার মাথায় ঢালে, সাধু জানায় আরও কয়েকশ ঘড়া ঢালতে হবে। শিবু মায়ের কষ্ট দেখে খচে ফায়ার হয়ে সাধুকে যা নয় তাই বলে নিজেই জল আনতে উদ্যত হয়। সাধু নির্লিপ্ত মুখে জানায় ওতে ফল হবেনি, যার পুজো তারেই জল বয়ে আনতে হবে। এবার রেগে আগুন হয়ে শিবু কোথা থেকে শাবল জোগাড় করে শাবলের তিন ঘায়ে সেই মস্ত বড় (এ সিনেমায় কিছুই ছোট নয়, সবই বিশালাকার) শিবলিঙ্গকে স্থানচ্যুত করে অবলীলায় ঘাড়ে ফেলে ইয়েতিসম ইয়া ইয়া পদক্ষেপে গিয়ে শিবকে একেবারে প্রপাতের তলাতেই বসিয়ে দিয়ে আসে, নে, কতো স্নান করবি কর !! এই কাঁধে শিব নিয়ে শিবুর ছবি অনেক জায়গায় দেখেছি মনে পড়লো। শ্রদ্ধায়, ভক্তিকে আমি ততক্ষণে আধমরা।

যাই হোক, এ হেন শিবুকে আটকাবে এমন পাহাড় এখনো তৈরি হয়নি, অতএব এক সুন্দর স্বর্নালী সন্ধ্যায় কুহকিনী মায়ার পিছু পিছু শিবু প্রায় খেলতে খেলতেই সে এভারেস্ট তুল্য পাহাড়- প্রপাত ডিঙ্গিয়ে ওপারে ক্যানাডায় উপস্থিত হয়। ক্যানাডা মনে হল কারণ চারদিকে বেশ বরফ ও মেলা অনুপ্রবেশকারী।  সেখানেই কাহিনীর পটভূমিকা অর্থাৎ মাহিশ্মতী সাম্রাজ্য। সেখানে অবশ্য এক কুচি বরফও নেই!

সেখানে এক দুষ্টু রাজা ও তার বাপ এক ভালো রানিকে শিকলে বেঁধে যাচ্ছেতাই অপমান করে চলেছে পঁচিশ বছর ধরে। সেই রানিই হলেন আমাদের শিবুর আসল মা। শিবুকে এই রানিকে সেখান থেকে উদ্ধার করতে হবে। এই গুরুদায়িত্ব ভুলে শিবু বেমক্কা এক ডানপিটে লড়াই খ্যাপা মেয়ের পেছনে প্রচুর ফুটেজ ব্যয় করতে থাকে।

একে অন্যকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মারে, খুনোখুনি লাগে আর কি। আমি টিপুকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্যে বল্লাম এইবার ওরা একে অন্যকে মেরে ফেলবে কী বল? সে বলল, না না দে আর ইন লাভ !! কী বলবো আর !! বেশী ঘাঁটালাম না!!

প্রণয় বলেছিল খুবই পারিবারিক সিনেমা, সবাই একসাথে বসে দেখা যায়, অথচ এইখানে দেখা গেলো সেই মেয়ের পেছনে ধাওয়া করতে করতে শিবু তার তাবু সদৃশ বিরাট ঘাঘরা খুলে আবার উলটো করে পরাচ্ছে, কারণ উলটো দিকটা লাল রং। রিভারসিব্ল ড্রেস যাকে বলে !! লাল রং পরে, মুখচোখ ধুয়ে সেই মেয়ে বেশ ‘নারীসুলভ’ ন্যাকামো করতে থাকে।

এবার আসা যাক মাহিশ্মতীর কথায়। সেখানে দেখা যায় দুষ্টু রাজা যার নাম বল্লালদেব, তার পেটাই করা বিরাট চেহারা। সে খেলাচ্ছলে ততোধিক বিরাট মুহুর্মুহু গর্জনকারী ষণ্ডকে সম্মুখ সমরে একেবারে পেড়ে ফেলে। এঁর সঙ্গেই লড়তে হবে আমাদের শিবুকে। কি অন্যায় !!

সেই রাজ্যের ভীষ্ম পিতামহ যার নাম কাটাপ্পা সে বুড়ো হয়েছে তবে এখনো তলোয়ারের এক কোপে অন্য তলোয়ারকে লম্বালম্বি চিরে দিতে পারে!!

আর বল্লালদেবের আছে এক রিট্র্যাক্টেব্ল গদা। সে এক সাঙ্ঘাতিক জিনিস। এর মধ্যেই রাজ্যের লোকজন শিবুকে দেখতে পেয়ে ‘বাহুবলী, বাহুবলী’ বলে মহা শোরগোল করে। জানা যায় বন্দিনী রানির বর যে রাজা সে বল্লভদেবের ভাই বাহুবলী, শিবু যেহেতু তার ছেলে, তাই তাকে হুবহু বাপের মতন দেখতে !!

এবারে কাটাপ্পা উবাচ ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যায় মাহিশ্মতী রাজ্যের থিঙ্কট্যাঙ্ক হলেন শিবগামী নামের এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহিলা, শিবু- বাহুবলীর সেই ঠাকুমা। তার কথাতেই গোটা রাজ্য ওঠে বসে। খুবই বিচক্ষণ ও তেজী এই মহিলার নিজের ছেলে বল্লালদেব আর ভাসুরের ছেলে বাহুবলী। দুজনকেই মানুষ করেন ইনি।

অতীতে মাহিশ্মতী রাজ্যের ওপর কালকেয় নামের এক ক্রুর রাজার দৃষ্টি পড়ে। তাঁকে ও তার দলবলকে মহাসাঙ্ঘাতিক টাইপ দেখতে। নামের সঙ্গে মেলানো তাঁদের গায়ের রং (কালো মাত্রেই বজ্জাৎ এটা শুধু পশ্চিমীরা মনে করে না, ভারতীয়দের মতন রেসিস্ট জগতে কম আছে), চুলে জট, উকুনও থাকা বিচিত্র নয়, গলায় মুণ্ডমালা, আর সকলের গুটখাখোরদের মতন বিচ্ছিরি কালো ছোপ পড়া দাঁত !! বোঝা যায়, তারা এলিট শ্রেণীভুক্ত নয়!! তারা অদ্ভুত ভাষায় টাগড়ায় শব্দ করে কথা বলে, যা বলে সেসব শুনলে গা পিত্তি জ্বলে যায়। সুতরাং যুদ্ধ লাগে!!

এদিকে টিপু ততটাই হিন্দি জানে যতটা আমি হিব্রু জানি, তাই এতক্ষণ ভাসা ভাসা বুঝলেও এইখানে হঠাৎ টিপু ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে যুদ্ধের খুঁটিনাটি মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। সে কী হাড় হিম করা যুদ্ধ রে ভাই!! কতরকম কায়দার অস্ত্র, আর কৌশল। কালকেয়রা ক্যাল খেলে টিপুর খিলখিল হাসি আর বাহুবলী বেকায়দায় পড়লে হুঙ্কার!! একবার বলল এইবার ওই নিনজারা শত্রুকে ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলবে!! নিনজা অর্থাৎ মাহিশ্মতীর সৈন্যদল 😀 পনেরো মিনিট পয়সা উসুল যুদ্ধের পর যথারীতি বাহুবলী জয়ী হয়।

পুরস্কার স্বরূপ বাহুবলীকে রাজা বানিয়ে দেবার আদেশ দেন শিবগামী। সব ঠিকঠাক, এমন সময় দেশ বেড়াতে গিয়ে বাহুবলী প্রেমে পড়ে যায় দেবসেনা নামের এক বীরাঙ্গনার সাথে। সে দিনেরবেলা আরচারি প্র্যাকটিস করে আর রাতের বেলা কৃষ্ণকে ঘুমপাড়ানি গেয়ে শোনায়!! এই খবর পেয়ে, ‘তোমরা যাকে করছ বিয়ে, আমিও তাকে চাই’ নীতিতে বিশ্বাসী কুচুটে শিরোমণি বল্লালদেব কুট কচালি করে দেবসেনার সাথে নিজের বিয়ের প্রতিশ্রুতি আদায় করে শিবগামীর কাছে। ওদিকে আবার কুন্তলা-রাজ্যে প্রেমে হাবুডুবু মহাপরাক্রমী বাহুবলী নেহাতই ছ্যাবলা ও ক্যাবলা বোকা-বোকা ভাবমূর্তি বানিয়ে দর্শকের পিত্ত প্রদাহ করতে থাকে। শিবগামী দেবসেনার উদ্যেশ্যে ঝুড়ি ঝুড়ি গয়না ইত্যাদি প্রেরণ করে বল্লালের হয়ে তার পানিপ্রার্থনা করেন। দেবসেনা বিরাট অ্যাটি দেখিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে দেয়! এদিকে বাহুবলী ও কাটাপ্পা খুকীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যায় কারণ বাহুবলী ভাবছে শিবগামী দেবসেনার সঙ্গে তার বিয়ে দেবেন!!! এখানেই ক্যাচালের সূত্রপাত!! দেবসেনা আক্ষরিক অর্থেই বাহুবলীর স্কন্ধে চাপে ও মাহিশ্মতী এসে উপস্থত হয়।

এসে ভুল বুঝতে পেরে দেবসেনা ক্যাট ক্যাট করে সম্রাজ্ঞী শিবগামীকে দু’কথা শুনিয়ে দেয়। সে ও ছাড়বে কেন, বড় বড় চোখ করে সেও পাল্টা দেয়। অতঃপর বীরগাথা পরিবর্তিত হয়ে থোড়-বড়ি সাস-বহু অলিগলি চলতে থাকে। শিবগামী রেগে মেগে বাহুবলীর রাজা সাজা ক্যান্সেল করে বল্লালকে রাজা সাজিয়ে দেয়, বাহুবলীকে সেনাপতি!! সেও নিজেকে ষোড়শ লুই মনে করে প্রেমের জন্যে এক কথায় রাজা হবার লুক্রেটিভ কেরিয়ার বিসর্জন দেয়। এদিকে কিলো কিলো গয়নাগাঁটি প্রত্যাখ্যান করা দেবসেনা অন্তঃসত্ত্বা হতেই লোভাতুর হয়ে সন্তানের জন্যে সিংহাসন দাবী করে বসে। না পেয়ে ঝাল মেটাতে শ্বশুরবাড়ি ও শাশুড়ি সম্পর্কে কুকথা বলে ও শাশুড়ির বিপক্ষে বরকে লেলিয়ে দেবার চেষ্টা করে।

মাঝখান থেকে দুমুখো কেস খেয়ে বাহুবলী ছাপোষা, এলেবেলে তাপস পাল কি সুখেন দাস টাইপের ভাবভঙ্গি করে খুন হয়!!!

এবারে আবার একপ্রস্থ অতি নাটকীয়, অতিরঞ্জিত, অতি ধুন্ধুমার, অতি বিরক্তিকর যুদ্ধের পর দেবসেনা উদ্ধার হয় ও তাহারা সুখে শান্তিতে কালাতিপাত করতে থাকে!!!

এর মধ্যে থেকে উপরি পাওনা বল্লালদেব। উরেঃ কি চেহারা !! পিঠের দিকে মেরুদণ্ডর দুপাশে নাম-জানি-না মাংসপেশিকে গুল্লি গুল্লি করে নাচাতে পারে লোকটা !!! ভাবা যায় !!! আর দেখতেও মারকাটারি। তবে সিনেমার আসল হিরো হলেন শিবগামী, কি চোখ, কি দাপট আর কি ব্যাক্তিত্ব!!

আর একটা কথা, বাহুবলী২ তে, শিবু ওরফে বাহুবলীর ঝাঁকড়া চুল কিছুটা পাতলা হয়েছে মনে হল, জলপ্রপাতের জলে চান করে করে নিশ্চয়ই!! সেই জলের তলায় বসিয়ে রাখা শিবের কি দুর্গতি হবে ভাবতেই আমার কেমন দুঃখ দুঃখ হচ্ছে, সত্যি বলছি 😀

1200x630bb

Leave a comment