দোলগোবিন্দর বিপদ

তা দোলগোবিন্দ বাবু স্ত্রী-পুত্র নিয়ে গেছিলেন চিড়িয়াখানা। বারোমাস বাইরে বেরোলে তিনি সঙ্গে একটা মার্কামারা কালো বোঁচকা পিঠে করে নিয়ে যান যাকে ভদ্র ভাষায় বলে ব্যাকপ্যাক। বলা যায়না, হঠাৎ যদি ভূমিকম্প হয়ে কোন খোঁদলে আটকা পড়েন, কিম্বা যদি জলোচ্ছ্বাসে পৃথিবী রসাতলে যাবার উপক্রম হয় ও দুষ্টু জল এনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কিম্বা যদি মাঝরাত্তিরে তেপান্তরে গাড়ী খারাপ হয় ও এনাকে একলা সেখানে রাত কাটাতে হয়, কিম্বা যদি ভিনগ্রহের প্রাণীরা পৃথিবী আক্রমণ করে ও এনাকে পালিয়ে গিরিকন্দরে দিনের পর দিন আশ্রয় নিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয় তাহলে যা যা লাগতে পারে, তার সবকিছুই এই বোঁচকায় মজুত থাকে। এক প্রস্থ জামাকাপড়, চিরুনি, জ্যাকেট, টুপি, ছোট কেক, বিস্কুট, চিরেভাজা, সানস্ক্রিন, চিউইংগাম ইত্যাদি এবং সর্বোপরি থাকে দুই থার্মোফ্লাস্ক ভর্তি জল। একুনে নাহক কিছু চোদ্দ পনেরো কেজি ওজন তো হবেই। যে কোনো জায়গায় গিয়ে নেমেই এই বোঁচকা পিঠে নিয়ে নেন ও সারাক্ষণ পিঠে করে ঘুরে বেড়ান। কোনওভাবে ওনার ধারণা জন্মেছে যে এই করে ফোকটে বেশ খানিকটা ব্যায়াম হয়ে যায়। ওরে পাগলা, সকালের এক ইঞ্চি পুরু মাখন দেওয়া পাঁউরুটি, কলা, মালাই-চা, তারপর দুপুরে কোম্পানির ঘাড় ভেঙে কোনোদিন ইটালিয়ান, কোনোদিন চাইনিজ, কোনোদিন ইরানী, পাকিস্তানি, মেক্সিকান হ্যান ত্যান, তারপর বিকেল হতেই চা লেরো বিস্কুট এবং রাতে একপো চালের ভাত সহযোগে পঞ্চব্যাঞ্জন কি আর সামান্য বোঁচকা বইলেই হজম হবে? তার জন্যে আরও কায়দার দরকার। যাই হোক, কে বোঝাবে।

তা বোঁচকা নিয়ে নিয়ে সর্বত্র ঘোরার পর একজায়গায় ‘ক্রেজি হাউস’ নামের এক ব্যাঁকা-ট্যারা বাড়ীর সামনে এসে হাজির হলেন। এখানে বাচ্চারা হঠাৎ প্রবল উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটে উঠল। বাড়িটা দোতলা, আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আড্ডা- টাড্ডা দিচ্ছিলাম, ততক্ষণে বাচ্চারা সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলো কলরব করতে করতে। খানিক পরেই তাদের ক্যালর ব্যালর শোনা গেলো নীচতলার সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে !! কেসটা কি সরেজমিন করতে আমি সেদিকে গেলাম, যাবার সময় দেখে গেলাম যে বাচ্চারা দোলগোবিন্দ বাবুকে বগলদাবা করে কি যেন বুঝিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে গিয়ে দেখি বাড়ীর দোতলা থেকে একটা সুরঙ্গ এঁকেবেঁকে  মাটির হাত খানেক ওপরে এসে শেষ হয়েছে। বেশ লম্বা পতনের পথ আর কি। বাচ্চারা সেই পথেই দোতলা থেকে নেমে এসেছে বোঝা গেলো, সেই জন্যেই তেনাদের এতো আনন্দ !! সুরঙ্গ দিয়ে ছোট ছোট সাইজের বালক বালিকারা অহরহই সাঁই করে নেমে আসছে ও দ্বিগুণ উৎসাহে আবার অন্যদিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে। যাক, সেই সুরঙ্গের অনতিদূরে দাঁড়িয়ে ফুল-পাখি- প্রজাপতি এসব দেখছি একমনে, গলায় গান আসবো আসবো করছে, এমন সময়ে, গদাম !!! সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে যা ঘটতে দেখলাম তা হল – দোলগোবিন্দ বাবুর সেই বিকট ভারী বোঁচকাটা হুউশ করে সুরঙ্গ দিয়ে উড়ে এসে মাটিতে পড়লো। যেহেতু দোলগোবিন্দবাবু ওটাকে কাছছাড়া করেননি, তাই বোঁচকার ওপর চিৎপাত অবস্থায় ছিলেন তিনি স্বয়ং। অর্থাৎ, পিঠে বোঁচকা অবস্থায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে তিনি উল্কার বেগে সুরঙ্গ বেয়ে এসে বিকট আওয়াজ করে ধুলোর ওপর ভূমিষ্ঠ হলেন!! বাচ্চাদের জন্যে বানানো সুরঙ্গে সোজা হয়ে বসতে পারেননি, তাই শুয়ে পড়তে হয়েছে, এবং পিঠে জন্মের ভারী ব্যাকপ্যাক থাকায় মোমেন্টামটা জম্পেশ রকম হয়েছে, তার ফলে এই মহাপতন ও কেলো।   দু সেকেন্ড সব চুপচাপ, দোলগোবিন্দ কিছু হয়নি এমন ভাব করে মাজা সামলে উঠতে গিয়ে দেখলেন সামনের পিকনিক বেঞ্চ থেকে সরু মোটা নানা গলায় ফিক ফিক, ফ্যাকর ফ্যাকর, হি হি, হা হা, হোহো, খ্যা খ্যা, খিক খিক ও খৌয়া খৌয়া সমবেত হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে। বিনি পয়সায় এমন বিনোদন তো সহজলভ্য নয়। এবং সামনেই সবথেকে হেঁড়ে গলায় হ্যাহ্যাহ্যাহ্যাহ্যা করে হেসে প্রায় লুটিয়ে পড়ে যাচ্ছে যে, সে আর কেউ নয় তাঁর অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করা বিশ্বাসঘাতক স্ত্রী। পাক্কা সাড়ে ছ’মিনিট পর কোনওমতে দম নিয়ে সে জিজ্ঞেস করলে, ‘কোথাও লাগেনি তো?’

কোন মানে হয়? অ্যাঁ?

 

One thought on “দোলগোবিন্দর বিপদ

Leave a comment